পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিভূতি-রচনাবলী والمناعة মাঝে মাঝে মূলী বাশের বন। নৈশ বাতাসে বঁাশপাতার মধ্যে সরসর শত্ৰ। রাত-জাগা কি পাখীর ডাক বাশবনের মগডালের দিকে। মাঝে মাঝে দূরের সমুদ্র দেখা যায়—এবার বেশ স্পষ্ট দেখা যায় জ্যোৎস্নালোকিত সমুদ্রবক্ষ, তবে সন্দ্বীপের তীররেখা চিনে নেবার উপায় নেই। চন্দ্রনাথের মন্দিরে আমরা গিয়ে পৌছুলাম । চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরে চন্দ্রনাথের মন্দির—এখান থেকে একটা দৃপ্ত বড় অদ্ভূত দেখলুম এই রাত্রে। মন্দিরের পাদদেশ থেকে ধাপে ধাপে গাছপালার ও বনঝোপের মাথা নেমে গিয়েচে কত নীচে, জ্যোৎস্নমণ্ডিত বনঝোপের মাথাগুলি অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়— তারপর নৈশ-কুয়াশায় বিলীন হয়ে অদৃপ্ত হয়ে গিয়েচে । মনে হয় আমি এক আছি, আমার পায়ের তলায় সারা বনময় পৃথিবীট--জ্যোৎস্নালোকিত সমুদ্র, শৈলশ্রেণী। মন্দিরের চারপাশে বারানাতে বসে রইলুম অনেক রাত পর্যস্ত। চাদ অস্ত গেলে আমার পায়ের তলায় বনভূমি গভীর অন্ধকারে ভরে গেল। সে রকম গভীর দৃপ্ত দেখবার সুযোগ জীবনে বেশিবার আমার ঘটেনি—দেখে বুঝেছিলাম মৃত্যুর আগে প্রত্যেক মাস্থ্য যেন গভীর নিস্তন্ধ রাত্রে আরণ্য-প্রকৃতির অন্ধকায় রূপ কোনো উত্তর শৈলশিখরে বসে দেখে, নতুবা সে বুঝতে পারবে না বিশ্বপ্রকৃতির অসীম ঐশ্বৰ। মন্দিরের পাশে একটা ছোট ঘরে আমরা শুয়ে রাত কাটাই । রাত্রে আমার ভালো ঘুম হল না—একটা বিরাট শৈলারণ্যের মধ্যে আমি শুয়ে আছি এ চিন্তাটা মন থেকে ঘুমের ঘোরেও গেল না, কতবার মনে হয়েচে জানাল দিয়ে চেয়ে বসে থাকি । নামবার পথে একটা পাহাড়ী ঝরনায় হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। বড় শিশির পড়েচে সারারাত ধরে গাছপালায় বনঝোপে। টুপটাপ করে শিশির ঝরে পড়চে, প্রভাতের সুর্যালোক মাঝে মাঝে গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাধানো সোপানশ্রেণী ওপর আলোছায়ার জাল বুনচে । পাণ্ডাঠাকুরের বাড়ি এসে দেখি—যা ভেবেচি তাই । তার কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত আমায় খোঁজাখুঁজি করেচেন। গ্রামের আট-দশজন লোক একত্র হয়ে লণ্ঠন ও লাঠি নিয়ে পাহাড়ের তলায় পর্যন্ত এসে অমুসন্ধান করেচেন। আজ সকালে থানার খবর দেবার আয়োজন করচেন। আমার আকস্মিক অন্তৰ্ধানে গ্রামের মধ্যে শোরগোল পড়ে গিয়েচে। তবে শেষ পর্যন্ত অনেকে নাকি ধরে নিয়েছিলেন যে আমি সন্ধ্যার ট্রেনে হঠাৎ কোনো কাজে হয়তে চাটগায়ে চলে গিয়েচি। পাণ্ডাঠাকুরের বাড়িতে অনেকে একসঙ্গে আমার ঘিরে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন, আমি কোথায় ছিলুম, রাত্রি কোথায় কাটালুম—ইত্যাদি। আমি রাত্রের ঘটনা বলতে ওরা সবাই মিলে, যারা আমার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের দোষ দিতে লাগলো। না জানিয়ে তাদের এ রকম নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি পাহাড়ের ওপরে।