পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৩৬ বিভূতি-রচনাবলী বাংলাদেশে আমি খুব নিরীহ লোক ভেবে যার কাছে হয়তে গিয়েচি, দেখেচি সে আসলে অনেক কিছু জানে বা বোঝে—ফলে তার মনের নিছক সারল্য নষ্ট হয়ে গিয়েচে। কিন্তু বাংলার বাইরে আমি আশ্চর্য ধরনের সরল ও নিরীহ লোক দেখেচি—তাদের শিশুমুলভ সারল্য কতবার আমাকে মুগ্ধ করেচে। আমি আমার জীবনে এ-ধরনের সরল লোক খুজে বেড়িয়েচি —আমার আবাল্য ঝোক ছিল এদিকে, মামুষের টাইপ খুজে বার করবো। আমার অভিজ্ঞতা দ্বারা দেখেচি বিহার ও সি-পিতে, ছোট নাগপুরে এই সরল টাইপট বেশ পাওয়া যায়। এখনও পাওয়া যায়। তবে আজকাল নষ্ট হয়ে যেতে বসেচে। মামুষের মনকে বর্তমান সভ্যতা ও শিক্ষা একটি কলের ছাচে গড়চে । সব এক ছাচ, রামও যা ভাবে শুমিও তাই ভাবে, যদু মধুও তাই ভাবে। যে আর একজনের মতো না ভাবে—তাকে লোকে মূর্খ বলে, অশিক্ষিতও বলে—মুতরাং সমাজের ভয়ে, লোকনিন্দার ভয়ে, শ্বশুরবাড়িতে শালীশালাদের শ্রদ্ধা হারাবার ভয়ে—লাকে অন্ত রকম ভাবতে ভয় পায়। ফলে শিল্পে, সাহিত্যে, সামাজিক রীতিনীতিতে একই ছাচের মনের পরিচয় পাওয়া যায় সর্বত্র, অনেক খুঁজেও থাটি ওরিজিন্তাল টাইপ বার করা যায় না। শহরে তো যায়ই না, শহর থেকে মুদুরে, নিভৃত পল্লী অঞ্চলেও বড় একটা দেখা যায় না। তবে বাংলার বাইরে, যেখানে ইউনিভারসিটি, খবরের কাগজ, রেডিও প্রভৃতির উৎপাত নেই, কিংবা শিক্ষিত লোকের যাতায়াত কম, এমন অরণ্য অঞ্চলে—নিকটে যেখানে রেলস্টেশন বা মোটর বাসের চলাচলের পথ নেই—সেখানে দু একটা অতি চমৎকার ছাচের মানুষ দেখেচি । - এদের আবিষ্কারের আনন্দ আমার কাছে একটা নতুন দেশ আবিষ্কারের সঙ্গে সমান। মোহাস্তজী অনেকটা সেই ধরনের মানুষ। তিনি রাত্রে মন্দিরে ফিরে যাবার আগে আমায় বিশেষ অনুরোধ করলেন আমি যেন আমার ভাগলপুরন্থ বন্ধুবান্ধবকে বলে তার মন্দির মেরামতের ও মন্দিরের আয় বাড়াবার একটা ব্যবস্থা করে দিই। অনেকখানি সরল আশা-ভরসা তার চোখে মুখে—বহু দূৰ্বকালের ছায়া তার জীবনে এমন একটি স্নিগ্ধ পরিবেশ রচনা করেচে—ত থেকে হুশিয়ার ও হিসাবদুরন্ত বর্তমানে তিনি কোনোদিনই যেন পৌছতে পারবেন না, কোনোদিনই বুঝবেন না এর কুটিলতা, আর আত্মম্বার্থবোধ। আমি বললুম—মোহান্তজী, আপনি চলে আসুন না ভাগলপুরে ? —আপনি যেতে বললেই যাবে, টাকা একসঙ্গে জড় হলে নিয়ে আসব গিয়ে। তারপর আমায় একান্ত চুপিচুপি বললেন—এই পাড়েজী আমার বড় সাহায্য করে— —কি রকম ? —ভদ্রলোক এলে ওর এখানে রাখি, ও আমাকেও মাঝে মাঝে রাত্রে এখানে খাওয়ায়, বেশ খাওয়ায়-দেখলেন তো ? ওর নিজের কারখানার ঘি মাখন—বাইরে কোথায় এমন পাবেন বলুন। রামচন্দ্রজী ওকে আরও দেবেন, বড় সাত্বিক লোক।