মামা জিজ্ঞেস করলেন—এখন বসবেন, না, ওবেলা?
—না, এবেলা বসা হবে না। মাছ চারে লাগতে দু’ঘণ্টা দেরি হবে। ততক্ষণ খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া যায়। একটু সকাল-সকাল যদি আহারের ব্যবস্থা . . .
—হ্যাঁ হ্যাঁ, সব হয়ে গেছে। আমিও জানি, আপনি এসেই খেতে বসবার জন্যে তাগাদা দেবেন। মাছ যারা ধরে, তাদের কাছে খাওয়া-টাওয়া কিছুই নয় খুব জানি। আর ঘণ্টা-খানেক পরেই জায়গা করে দেবো খাওয়ার।
যথাসময়ে হরিশ গাঙ্গুলি খেতে বসলেন এবং একা প্রায় তিনজনের উপযুক্ত খাদ্য উদরসাৎ করলেন।
আমি কলকাতার ছেলে, দেখে তো অবাক্!
আমার মামা জিজ্ঞেস করলেন—গাঙ্গুলিমশায়, আর একটু পায়েস?
—তা একটুখানি না হয় . . . . . . ওসব তো খেতে পাইনে! একা হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাই। বাড়িতে মেয়েমানুষ নেই, বৌমারা থাকেন বিদেশে আমার ছেলের কাছে। কে ওসব ক’রে দেবে?
—গাঙ্গুলিমশায় কি একাই থাকেন?
—একাই থাকি বইকি। ছেলেরা কলকাতায় চাকরি করে, আমার শহরে থাকা পোষায় না। তাছাড়া কিছু নগ্দী লেন-দেনের কারবারও করি, প্রায় তিন হাজার টাকার ওপর। টাকায় দু’আনা মাসে সুদ। আপনার কাছে আর লুকিয়ে কি করবো? কাজেই বাড়ী না থাকলে চলে কই? লোকে প্রায়ই আসচে টাকা দিতে-নিতে।
গাঙ্গুলিমশায় এই কথাগুলো যেন বেশ একটু গর্ব্বের সঙ্গে বল্লেন।
আমি পল্লীগ্রাম সম্বন্ধে তত অভিজ্ঞ না হলেও আমার মনে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব দেখা দিলে। টাকা-কড়ির কথা এ-ভাবে লোকজনের কাছে ব’লে লাভ কি! বলা নিরাপদও নয়—শোভনতা ও রুচির কথা যদি বাদই দিই।
গাঙ্গুলিমশায়কে আমার বেশ লাগলো।
মাছ ধরতে-ধরতে আমার সঙ্গে তিনি অনেক গল্প করলেন।
. . . থাকেন তিনি খুব সামান্য ভাবে—কোনো আড়ম্বর নেই—খাওয়া-দাওয়া বিষয়েই কোনো ঝঞ্ঝাট নেই তাঁর। . . . এই ধরনের অনেক কথাই হলো।
মাছ তিনি ধরলেন বড়-বড় দুটো। ছোট গোটা-চার-পাঁচ। আমার মামাকে অর্দ্ধেকগুলি দিতে চাইলেন, মামা নিতে চাইলেন না। বল্লেন—কেন গাঙ্গুলিমশায়? পুকুরে মাছ ধরতে এসেছেন, তার খাজনা নাকি?
গাঙ্গুলিমশায় জিব কেটে বল্লেন—আরে রামো! তাই ব’লে কি বলচি? রাখুন অন্তত গোটা-দুই!
—না গাঙ্গুলিমশায়, মাপ করবেন, তা নিতে পারবো না। ও নেওয়ার নিয়ম নেই আমাদের।