পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মিস্‌মিদের কবচ
২১১

ঢুকেছি, জায়গাটার একদিকে ঝর্ণা, একদিকে উঁচু পাহাড়, তার গায়ে ঘন বাঁশবন। ওদিকে প্রায় সব পাহাড়েই বাঁশবন অত্যন্ত বেশি। কখনো গিয়েচেন ওদিকে?

আমি বল্লাম—না, তবে খাসিয়া পাহাড়ে এমন বাঁশবন দেখেচি, শিলং যাওয়ার পথে।

জানকীবাবুর গল্পটা আমি আমার নিজের ধরণেই বলি।

সেই পাহাড়ী-বাঁশবনে বন কাটবার জন্যে ঢুকে তাঁরা দেখলেন, এক জায়গায় একটা বড় শালগাছের নীচে আমাদের দেশের বৃষ-কাষ্ঠের মত লম্বা ধরণের কাঠের খোদাই এক বিকটমূর্ত্তি দেবতার বিগ্রহ!

কুলিরা বল্লে—বাবু, এ মিস্‌মিদের অপদেবতার মূর্ত্তি, ওদিকে যাবেন না।

জানকীবাবুর সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, তাঁর শখ হোলো মূর্ত্তিটার ফটো নেবেন। কুলির বারণ করলে, জানকীবাৰু তাদের কথায় কর্ণপাত না ক’রে ক্যামেরা তেপায়ার উপর দাঁড় করিয়েছেন, এমন সময় একজন বৃদ্ধ মিস্‌মি এসে তাদের ভাষায় কি বল্লে। জানকীবাবুর একজন কুলি সে ভাষা জানতো। সে বল্লে—বাবু, ফটো নিও না, ও বারণ করচে।

অন্য-অন্য কুলিরাও বল্লে—বাবু, এরা জবর জাত—সরকারকে পর্য্যন্ত মানে না। ওদের দেবতাকে অপমান করলে গাঁ-সুদ্ধ তীর-ধনুক নিয়ে এসে হাজির হয়ে আমাদের সবগুলোকে গাছের সঙ্গে গেঁথে ফেলবে। ওরা দুনিয়ার কাউকে ভয় করে না, কারো তোয়াক্কা রাখে না—ওদের দেবতার ফটো খিঁচ্‌বার দরকার নেই।

জানকীবাবু ক্যামেরা বন্ধ করলেন—এতগুলো লোকের কথা ঠেলতে পারলেন না। তারপর নিজের কাজকর্ম্ম সেরে তিনি যখন জঙ্গল থেকে ফিরবেন, তখন আর একবার সেই দেবমূর্ত্তি দেখবার বড় আগ্রহ হোলো।

সন্ধ্যার তখন বেশি দেরি নেই, পাহাড়ী-বাঁশবনের নিবিড় ছায়া-গহন পথে বন্য-জন্তুদের অতর্কিত আক্রমণের ভয়, বেণুবনশীর্ষে ক্ষীণ সূর্য্যালোক ও পার্ব্বত্য-উপত্যকার নিস্তব্ধতা সকলের মনে একটা রহস্যের ভাব এনে দিয়েচে, কুলিদের বারণ সত্ত্বেও তিনি সেখানে গেলেন।

সবাই ভীত ও বিস্মিত হয়ে উঠলো যখন সেখানে গিয়ে দেখলে, কোন্ সময় সেখানে একটি শিশু বলি দেওয়া হয়েচে! শিশুটির ধড় ও মুণ্ড পৃথক-পৃথক প’ড়ে আছে, কাঠে-খোদাই বৃষকাষ্ঠ জাতীয় দেবতার পাদমূলে! অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঁচা আধ-শুকনো রক্ত।

সেখানে সেদিন আর তাঁরা বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না...

জানকীবাবু বল্লেন—আমার কি কুগ্রহ মশায়, আর যদি সেখানে না যাই তবে সবচেয়ে ভালো হয়, কিন্তু তা না ক’রে আমি আবার পরের দিন সেখানে গিয়ে হাজির হোলাম। কুলীদের মধ্যে একজন লোক আমায় যথেষ্ট নিষেধ করেছিল, সে বলেছিল, ‘বাবু, তুমি কলকাতার লোক, এসব দেশের গতিক কিছু জানো না। জংলী-দেবতা হোলেও ওদের একটা শক্তি আছে—তা তোমাকে ওদের পথে নিয়ে যাবে, তোমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে—ওখানে অত যাতায়াত কোরো না বাবু।’ কিন্তু কারো কথা শুনলাম না, গেলাম শেষ পর্য্যন্ত। লুকিয়েই গেলাম, পাছে কুলির টের পায়।