পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

80 বিভূতি-রচনাবলী বুঝেছ নিশ্চয়। পাহাড়ের কোলে কোলে পশ্চিম দিকে চল। যেখানে ঢালু এবং নীচু পাবো, সেখান দিয়েই পাহাড় পার হতে হবে। কিন্তু এই দেড়শো মাইল লম্বা পৰ্ব্বতশ্রেণীর মধ্যে কোথায় সে-রকম জায়গা আছে, এ খুজতেই তো এক মাসের ওপর যাবে দেখছি। কিন্তু দিন পাচ-ছয় পশ্চিম দিকে যাওয়ার পরে এমন একটা জায়গা পাওয়া গেল, যেখানে পৰ্ব্বতের গা বেশ ঢালু, সেখান দিয়ে পৰ্ব্বতে ওঠা চলতে পারে। পরদিন খুব সকাল থেকে পৰ্ব্বতারোহণ শুরু হল। শঙ্করের ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে ছ’টা । সাড়ে আটটা বাজতে না বাজতে শঙ্কর আর চলতে পারে না। যে জায়গাটা দিয়ে তারা উঠছে—সেখানে পৰ্ব্বতের চার মাইলের মধ্যে উঠেছে ছ’হাজার ফুট, সুতরাং পথটা ঢালু হলেও কী ভীষণ দুরারোহ তা সহজেই বোঝা যাবে। তা ছাড় ধতই ওপরে উঠছে অরণ্য ততই নিবিড়তর, ঘন অন্ধকার চারিদিক, বেলা হয়েছে, রোদ উঠেছে, অথচ স্থৰ্য্যের আলো ঢোকে নি জঙ্গলের মধ্যে—আকাশই চোখে পড়ে না তায় স্থৰ্য্যের আলো ! পথ বলে কোনো জিনিস নেই। চোখের সামনে শুধুই গাছের গুড়ি যেন ধাপে ধাপে আকাশের দিকে উঠে চলেছে। কোথা থেকে জল পড়েছে কে জানে, পায়ের নীচের প্রস্তর আর্দ্র ও পিচ্ছিল, প্রায় সৰ্ব্বত্রই পাথরের ওপর শেওলা-ধরা। পা পিছলে গেলে গড়িয়ে নীচের দিকে বহুদূর চলে গিয়ে তীক্ষ শিলাখণ্ডে আহত হতে হবে। শঙ্কর বা আলভারেজ কারো মুখে কথা নেই। এই উত্ত,স্ব পথে ওঠবার কষ্টে দুজনেই অবসর, দুজনেরই ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। শঙ্করের কষ্ট আরও বেশী, বাংলার সমতলভূমিতে আজন্ম মানুষ হয়েছে, পাহাড়ে ওঠার অভ্যাসই নেই কখনো । শঙ্কর ভাবছে, আলভারেজ কখন বিশ্রাম করতে বলবে। সে আর উঠতে পারছে না, কিন্তু যদি সে মরেও যায়, একথা আলভারেজকে সে কখনই বলবে না যে, সে আর পারছে না। হয়তে তাতে আলভারেজ ভাববে, ঈস্ট, ইণ্ডিজের মানুষগুলো দেখছি নিতান্ত অপদার্থ। এই মহাদুর্গম পৰ্ব্বত ও অরণ্যে সে ভারতের প্রতিনিধি—এমন কোন কাজ সে করতে পারে না যাতে তার মাতৃভূমির মুখ ছোট হয়ে যায়। বড় চমৎকার বন, যেন পরীর রাজ্য, মাঝে মাঝে ছোটখাটো ঝরনা বনের মধ্যে দিয়ে খুব ওপর থেকে নীচে নেমে যাচ্ছে। গাছের ডালে ডালে নানা রঙের টিয়াপার্থী চোখ ঝলসে দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। বড় বড় ঘাসের মাথায় সাদা সাদা ফুল, আকিডের ফুল ঝুলছে গাছের ডালের গায়ে, গুড়ির গায়ে। হঠাৎ শঙ্করের চোখ পড়ল, গাছের ডালে মাঝে মাঝে লম্বা দাড়ি-গোপওয়ালা বালখিল্য মুনিদের মত ও কার বসে রয়েছে। তারা সবাই চুপচাপ বসে, মুনিজনোচিত গাজীৰ্য্যে ভরা। ব্যাপার কি ? আলভারেজ বললে—ও কলোবাস জাতীয় মাদী বানর। পুরুষ জাতীয় কলোবাস বানরের দাড়ি-গোপ নেই, স্ত্রী জাতীয় কলোবাস বানরের হাতখানেক লম্ব দাড়ি-গোপ গজায় এবং তারা বড় গম্ভীর, দেখেই বুঝতে পাচ্ছ।