পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক Ե Գ ঘরবাড়ী নাই, মোটর-হর্ণের আওয়াজ নাই, ঘন ঘুমের ফঁাকে যেখানে কেবল দূর অন্ধকার বনে শেয়ালের দলের প্রহর-ঘোষণা শোনা যায়, নয়তো ধাবমান নীল-গাইয়ের দলের সম্মিলিত পদধ্বনি, নয়তো বন্ত মহিষের গম্ভীর আওয়াজ । আমার উপরওয়ালারা ক্রমাগত আমাকে চিঠি লিখিয়া তাগাদ করিতে লাগিলেন, কেন আমি এথানকার জমি প্রজাবিলি করিতেছি না। আমি জানি আমার তাহাই একটি প্রধান কাজ বটে, কিন্তু এখানে প্রজা বসাইরা প্রকৃতির এমন নিভৃত কুঞ্জবনকে নষ্ট করিতে মন সরে না । যাহারা জমি ইজারা লইবে, তাহারা তো জমিতে গাছপালা বনঝোপ সাজাইয়া রাখিবার জন্য কিনিবে না-কিনিয়াই তাহারা জমি সাফ করিয়া ফেলিবে, ফসল রোপণ করিবে, ঘরবাড়ী বাধিয়া বসবাস শুরু করিবে—এই নির্জন শোভাময় বস্ত প্রাস্তর, অরণ্য, কুত্তী, শৈলমাল জনপদে পরিণত হইবে, লোকের ভিড়ে ভয় পাইয়া বনলক্ষ্মীরা উৰ্দ্ধশ্বাসে পলাইবেন—মানুষ ঢুকিয়া এই মায়া-কাননের মায়াও দূর করিবে, সৌন্দৰ্য্যও যুচাইয়া দিবে। সে জনপদ আমি মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখিতে পাই – পাটনা, পূর্ণিয়া কি মুঙ্গের যাইতে তেমন জনপদ এদেশের সর্বত্র। গায়ে গারে কুত্ৰ বেঢপ খোলার একতলা কি দোতলা মাঠকোঠা, চালে চালে বসতি কনি-মনসার ঝাড়, গোবরস্তুপের আবর্জনার মাঝখানে গরু-মহিষের গোয়াল-ইদারা হইতে রহট্ট, দ্বারা জল উঠানো হইতেছে, ময়লা কাপড় পর। নর-নারীর ভিড়, হনুমানজীর মন্দিরে ধ্বজা উড়িতেছে, রুপার হামুলি গলার উলঙ্গ বালক-বালিকার দল ধূলা মাখিয়া রাস্তার উপর খেলা করিতেছে। কিসের বদলে কি পাওয়া যাইবে ! এমন বিশাল ছেদহীন, বাধাবন্ধনহীন উদাম সৌন্দৰ্য্যময়ী অরণ্যভূমি দেশের একটা বড় সম্পদ-অন্ত কোন দেশ হইলে আইন করিয়া এখানে স্যাশনাল পার্ক করিয়া রাখিত। কৰ্ম্মক্লাস্ত শহরে মানুষ মাঝে মাঝে এখানে আসিয়া প্রকৃতির সাহচর্য্যে নিজেদের অবসন্ন মনকে তাজা করিয়া লইয়া ফিরিত। তাহা হইবার জো নাই, যাহার জমি সে প্রজাবিলি না করিয়া জমি ফেলিয়া রাখিবে কেন । আমি প্রজা বসাইবার ভার লইয়া এখানে আসিয়াছিলাম—এই অরণ্যপ্রকৃতিকে ধ্বংস করিতে আসিয়া এই অপূৰ্ব্বমুন্দরী বন্ত নায়িকার প্রেমে পড়িয়া গিয়াছি। এখন আমি ক্রমশঃ সে-দিন- পিছাইয়া দিতেছি। যখন ঘোড়ায় চড়িয়া ছায়াগহন বৈকালে কিংবা মুক্তাশুভ্র জ্যোৎস্নারাত্রে একা বাহির হই, তখন চারিদিকে চাহিয়া মনে মনে ভাবি, আমার হাতেই ইহা নষ্ট হইবে ? জ্যোৎস্নালোকে উদাস আত্মহারা, শিলাস্তৃত ধুধু নির্জন বন্ত প্রান্তর! কি করিয়াই আমার মন ভুলাইয়াছে চতুরা সুন্দরী। কিন্তু কাজ যখন করিতে আসিয়াছি, করিতেই হইবে। মাঘমাসের শেষে পাটনা হইতে ছটু সিং নামে এক রাজপুত আসিয়া হাজার বিঘা জমি বন্দোবস্ত লইতে চাহিয়া দরখাস্ত দিতেই আমি বিষম চিন্তায় পড়িলাম—হ{জার বিঘা জমি দিলে ত অনেকটা জায়গাই নষ্ট হইয়া ধাইবে —কত সুন্দর বুনঝোপ, লতাবিতান নিৰ্ম্মমভাবে কাটা পড়িবে যে !