পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক ১৩৭ মঞ্চী বলিল—জানেন বাবুজী, আমি সেখানে নাইতে গিয়ে মার খেয়েছিলাম। আমাকে নাইতে দেয় নি! মন্ধীর স্বামী বলিল—হ্যা, সে এক কাণ্ড বাবুজী। ভারী বদমাইস সেখানকার পাণ্ডার দল। বলিলাম--ব্যাপারখানা কি ? মক্কী স্বামীকে বলিল—তুমি বল না বাবুজীকে। বাবুজী কলকাতায় থাকেন, উনি লিখে দেবেন। তখন বদমাইস গুগুরো মজা টের পাবে। নকৃছেদী বলিল—বাবুজী, ওর মধ্যে স্বর্য-কুণ্ড খুব ভাল জায়গা। যাত্রীরা সেখানে স্নান করে। আমরা আমলাতলীর পাহাড়ের নীচে কলাই কাটছিলাম,পূর্ণিমার যোগ পড়লো কিনা ? মঞ্চী নাইতে গেল ক্ষেতের কাজ বন্ধ রেখে । আমার সেদিন জর, আমি নাইবো না । বড় বেী তুলসীও গেল না, ওর তত ধর্শের বাতিক নেই। মঞ্চী সূর্য-কুণ্ডে নামতে যাচ্ছে, পাণ্ডারা বলেছে—এই ওখানে কেন নামছিস ? ও বলেছে--জলে নাইবো । তার বলেছে—তুই কি জাত ? ও বলেছে—গাঙ্গেীতা । তখন তারা বলেছে—গাঙ্গোতীনকে আমরা নাইতে দিই নে কুণ্ডের জলে, চলে যা ! ও তো জানেন তেজী মেয়ে। ও বলেছে—এ তো পাহাড়ী ঝরনা, যে সে নাইতে পারে। ঐ তো কত লোক নাইছে। ওরা কি সকলে ব্রাহ্মণ আর ছত্ৰী ? বলে যেমন নামতে গিয়েছে, দুজন ছুটে এসে ওকে টেনে হিচড়ে মারতে মারতে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলে । ও কাদতে কঁদিতে ফিরে এল । —তার পর কি হল ? —কি হবে বাবুজী ? আমরা গরীব গাঙ্গোত কাটনি মজুর। আমাদের ফরিয়াদ কে শুনবে। আমি বলি, কঁাদিস নে, তোকে আমি মুঙ্গেরের সীতাকুণ্ডে নাইয়ে আনবো। মঞ্চী বলিল—বাবুজী, তা পনি একটু লিখে দেবেন তো কথাটা। আপনাদের বাঙালী বাবুদের—কলমের খুব জোর। পাজীগুলো জব হয়ে যাবে। উৎসাহের সহিত বলিলাম—নিশ্চয়ই লিখবো । তাহার পর মঞ্চী পরম যত্নে আমায় খাওয়াইল। বড় ভাল লাগিল তাহার আগ্রহ ও সেবাযত্ন । বিদায় লইবার সময় তাহাকে বার-বার বলিলাম—সামনের বৈশাখ মাসে যব গম কাটুনির সময় তারা যেন নিশ্চয়ই আমাদের লবটুলিয়া-বইহারে যায়। মঞ্চী বলিল—ঠিক যাব বাবুজী । সে কি আপনাকে বলতে হবে! মঞ্চীর আতিথ্য গ্রহণ করিয়া চলিয়া আসিবার সময় মনে হইল, আনন্দ, স্বাস্থ্য ও সারল্যের প্রতিমূৰ্ত্তি যেন সে। এই বনভূমির সে যেন বনলক্ষ্মী, পরিপূর্ণযৌবন, প্রাণময়ী, তেজস্বিনী অথচ মুগ্ধ, অনভিজ্ঞ, বালিকাস্বভাবা । বাঙালীর কলমের উপর অসীম নির্ভরশীল। এই বন্ত মেয়েটির নিকট সেদিন যে অঙ্গীকার করিয়া আসিয়াছিলাম, আজ তাহ পালন করিলাম—জানি না ইহাতে এতকাল পরে তাহার কি উপকার হইবে। এতদিন সে কোথায়, কি ভাবে আছে, বাচিয়া আছে কি না তাহাই বা কে জানে!