পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিভূতি-রচনাবলী পিছনের বনেই শিয়াল ডাকিতেছে—এই কয়টি ছোট ছেলেমেয়ে লইয়া উহাদের মা যে কেমন করিয়া এই নির্জন বনে-প্রাস্তরে থাকে, তাহা বুঝিরা উঠা কঠিন। হে বিজ্ঞ, রহস্যময় অরণ্য, আশ্রিত জনের প্রতি তোমার সত্যই বড় কৃপা । কথায় কথায় বলিলাম—মঞ্চী নিজের জিনিস সব নিয়ে গিয়েছে ? মুরতিয়া বলিল—ছোটমা কোন জিনিস নিয়ে যায় নি! ওর যে বাক্সট সেবার দেখেছিলেন—ফেলেই রেখে গিয়েছে। দেখবেন ? আনছি। বাক্সটা আনিয়া সে আমার সামনে খুলিল। চিরুণী, ছোট আয়না, পুতির মালা, একথান সবুজ রঙের খেলো রুমাল—ঠিক যেন ছোট খুঁকির পুতুল-খেলার বাক্স! সেই হিংলাজের মালাছডাটা কিন্তু নাই, সেবার লবটুলিয়া খামারের সেই যেটা কিনিয়াছিল। কোথায় চলিয়া গেল নিজের ঘর-সংসার ছাডিয়া কে বলিবে ? ইহার তো জমি লইয়া এতদিন পরে গৃহস্থালি পাতাইয়া বসবাস শুরু করিয়াছে, ইহাদের দলের মধ্যে সে-ই কেবল যে-ভবঘুরেই রহিয়া গেল! ঘোড়ায় উঠবার সময় স্বরতিয়া বলিল-আর এক দিন আসবেন বাবুজী—আমরা পার্থী ধরি ফাদ পেতে। নূতন ফাদ বুনেছি। একটা ডাহুক আর একটা গুডগুডি পাখী পুষেছি। এরা ডাকলে বনের পাখী এসে ফাদে পড়ে—আজ আর বেলা নেই—নইলে ধরে দেখাতাম— নাঢ়া বইহারের বন-প্রান্তরের পথে এত রাত্রে আসিতে ভয় ভয় করে। বায়ে ছোট একটি পাহাড়ী ঝরনার জলস্রোত কুলকুল করিয়া বহিতেছে, কোথায় কি বনের ফুল ফুটিয়াছে, গন্ধে ভরা অন্ধকার এক-এক জায়গায় এত নিবিড় যে ঘোড়ার ঘাড়ের লোম দেখা যায় না, আবার কোথাও নক্ষত্রীলোকে পাতলা । নাঢ়া বইহার নানাপ্রকার বুক্ষলতা, বন্যজন্তু ও পার্থীদের আশ্রয়স্থান-প্রকৃতি ইহার বনভূমি ওপ্রান্তরকে অজস্র সম্পদে সাজাইয়াছে, সরস্বতী কুণ্ডী এই নাঢ় বইহারেরই উত্তর সীমানায়। প্রাচীন জরিপের থাক-নক্সায় দেখা যায় সেখানে কুশীনদীর প্রাচীন খাত ছিল—এখন মজিয়া মাত্র ঐ জলটুকু অবশিষ্ট আছে—অন্ত দিকে সেই প্রাচীন খাতই ঘন অরণ্যে পরিণত— পুরা যত্র স্রোত পুলিনমধুনা তত্র সরিতামৃ— কি অবর্ণনীয় শোভা দেখিলাম এই বনভূমির সেই নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত্রে । কিন্তু মন খারাপ হইয়া গেল যখন বেশ বুঝিলাম নাঢ়া বইহারের এ বন আর বেশী দিন নয়। এত ভালবাসি ইহাকে অথচ আমার হাতেই ইহা বিনষ্ট হইল। দু-বৎসরের মধ্যেই সমগ্র মহালটি প্রজাবিলি হইয়া কুলী টোলা ও নোংরা বস্তিতে ছাইয়া ফেলিল বলিয়। প্রকৃতি নিজের হাতে সাজানো তার শত বৎসরের সাধনার ফল এই নাঢ়া-বইহার, ইহার অতুলনীয় বন্ত সৌন্দৰ্য্য ও দুরবিপর্সী প্রান্তর লইয়া বেমালুম অন্তৰ্হিত হইবে। অথচ কি পাওয়া যাইবে তাহার বদলে ? কতকগুলি খোলার চালের বিত্র ঘর, গোয়াল, মকাই জনারের ক্ষেত, শোনের গাদা, দড়ির চার-পাই, হকুমানজীর ধ্বজ, ফনিমনসার গাছ, যথেষ্ট দোক্তা, যথেষ্ট খৈনী, যথেষ্ট কলেরা ও বসন্তের মড়ক ।