পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক X ☾ó ন—সে একাই ঘণ্টায় পাচ সের গম কুটির ছাতু করিতে পারে। হায় হতভাগিনী বাঙালী কুমারী ! এত বৎসর পরেও সে নিশ্চয় আজও গাঙ্গেীতীন সাজিয়া দাদার সংসারে যব কুটিতেছে, কলাইয়ের বোঝা মাথায় করিয়া মাঠ হইতে আনিতেছে, কে আর দরিদ্রা দেহাতী বয়স্ক মেয়েকে বিনাপণে বিবাহ করিয়া পান্ধীতে তুলিয়া ঘরে লইয়৷ গিয়াছে, মঙ্গলশঙ্খ ও উলুধ্বনির মধ্যে ! শান্ত মুক্ত প্রান্তরে যখন সন্ধ্যা নামে, দূর পাহাড়ের গা বাহিয়া যে সরু পথটি দেখা যায় ঘনবনের মধ্যে চেরা সিথির মত, ব্যর্থযৌবনা, দরিদ্র ধ্রুবা হয়তো আজও এত বছরের পরে সেই পথ দিয়া শুকনো কাঠের বোঝা মাথায় করিয়া পাহাড় হইতে নামে—এ ছবি কতবার . কল্পনানেত্রে প্রত্যক্ষ করিয়াছি—তেমনি প্রত্যক্ষ করিয়াছি আমার দিদি, রাখালবাবুর স্ত্রী, হয়তো আজও বৃদ্ধ গাঙ্গোতীনদের মত গভীর রাত্রে চোরের মত লুকাইয়া ক্ষেতে থামারে শুকনো তলায়-ঝরা ভুটা ঝুড়ি করিয়া কুড়াইয়া ফেরেন । Nව ভানুমতীদের ওখান হইতে ফিরিবার পরে শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সেবার ঘোরা বর্ষা নামিল । দিনরাত অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, ঘন কাজল-কালো মেঘপুঞ্জে আকাশ ছাইয়াছে ; নাঢ় ও ফুলকিয়া বইহারের দিগন্তরেখা বৃষ্টির ধোয়ার ঝাপসা, মহলিখারূপের পাহাড় মিলাইয়া গিয়াছে— মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের শীর্ষদেশ কখনও ঈষৎ অস্পষ্ট দেখা যায়, কখনও যায় না। শুনিলাম পূৰ্ব্বে কুশী ও দক্ষিণে কারো নদীতে বঙ্গ আসিয়াছে। মাইলের পর মাইল ব্যাপিয়া কণশ ও ঝাউবন বর্ষার জলে ভিজিতেছে, আমার আপিসঘরের বারান্দায় চেয়ার পাতিয়া বসিয়া দথিতাম, আমার সামনে কাশবনের মধ্যে একটা বনবাউয়ের ডালে একটা সঙ্গীহারা ঘুঘু বসিয়া অঝোরে ভিজিতেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টাএকভাবেই বসিয়া আছে—মাঝে মাঝে পালক উস্কোখুসকো করিয়া ঝুলাইয়া বৃষ্টির জল আটকাইবার চেষ্টা করে, কখনও এমনিই বসিয়া থাকে। এমন দিনে আপিস-ঘরে বসিয়া দিন কাটানো আমার পক্ষে কিন্তু অসম্ভব হইয়া উঠিত। ঘোড়ায় জিন কম্বিয়া বর্ষাতি চাপাইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম। সে কি মুক্তি! কি উদাম জীবনানন্দ । আর, কি অপরূপ সবুজের সমুদ্র চারিদিকে—বর্ষার জলে নবীন, সতেজ, ঘনসবুজ কাশের বন গজাইয়া উঠিয়াছে—যত দূর দৃষ্টি চলে, এদিকে নাঢ় বইহারের সীমানা ওদিকে মোহনপুরা অরণ্যের অস্পষ্ট নীল সীমারেখা পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত থৈ থৈ করিতেছে—এই সবুজের সমুদ্র —বৰ্ষ সজল হাওয়ায় মেঘকজল আকাশের নীচে এই দীর্ঘ মরকতাম তৃণভূমির মাথায় ঢেউ খেলিয়া যাইতেছে—আমি যেন একা এ অকুল-সমুদ্রের নাবিক—কোন রহস্যময় স্বপ্নবন্দরের উদ্দেঙ্গে পাড়ি দিয়াছি। -