পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক Ꮌ☾ কিছু নাই, এদেশের রীর্তি অনুযায়ী গায়ে একটা মেরজাই থাকা উচিত ছিল, তা পৰ্য্যন্ত নাই। অনেকক্ষণ হইতে আমি লক্ষ্য করিতেছিলাম, সে সকলের দিকে কেমন কুষ্ঠিতভাবে চাহিতেছিল, কারও কথার কোনও প্রতিবাদ করিতেছিল না, অথচ কথা যে সে কম বলিতেছিল তা নয়। আমার প্রতি কথার উত্তরে কেবল সে বলে—হুজুর। এদেশের লোকে যখন কোন মান্ত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কথা মানিয়া লয়, তখন কেবল মাথা সামনের দিকে অল্প বাকাইয়া সসন্ত্রমে বলে—হুজুর। গনোরীকে বলিলাম—তুমি থাকো কোথায়, তেওয়ারীজি ? আমি যে তাহাকে সরাসরি প্রশ্ন করিব, এতটা সম্মান যেন তাহার পক্ষে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, এভাবে সে আমার দিকে চাহিল। বলিল—ভীমদাসটোলা, হুজুর। তার পর সে তাহার জীবনের ইতিহাস বর্ণনা করিয়া গেল, একটানা নয়, আমার প্রশ্নের উত্তরে টুকুর টুকরা ভাবে। গনোরী তেওয়ারীর বয়স যখন বারে বছর, তার বাপ তখন মারা যায়। এক বৃদ্ধ পিসিম তাহাকে মানুষ করে, সে পিসিমাও বাপের মৃত্যুর বছর-পাচ পরে যখন মারা গেলেন, গনোরী তখন জগতে ভাগ্য অন্বেষণে বাহির হইল। কিন্তু তাহার জগৎ পূৰ্ব্বে পূৰ্ণিয়া শহর, পশ্চিমে ভাগলপুর জেলার সীমান, দক্ষিণে এই নির্জন অরণ্যময় ফুলকিয়া বইহার, উত্তরে কুশী নদী— ইহারই মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইহারই মধ্যে গ্রামে গ্রামে গৃহস্থের দুয়ারে ফিরিয়া কখনও ঠাকুরপূজা করা, কখনও গ্রাম্য পাঠশালায় পণ্ডিত করিয়া কায়ক্লেশে নিজের আহারের জন্ত কলাইয়ের ছাতু ও চীন ঘাসের দানার রুটির সংস্থান করিয়া আসিয়াছে। সম্প্রতি মাস দুই চাকুরি নাই, পৰ্ব্বত গ্রামের পাঠশাল উঠিয়া গিয়াছে, ফুলকিয়া বইহারের দশ হাজার বিঘা অরণ্যময় অঞ্চলে লোকের বস্তি নাই—এখানে ”ে মহিষ-পালকের দল মহিষ চরাইতে আনে জঙ্গলে, তাহাদের বাথানে বাথানে ঘুরিয়া খাদ্যভিক্ষা করিয়া বেড়াইতেছিল—আজ আমার আসিবার খবর পাইয়া অনেকের সঙ্গে এখানে আসিয়াছে । আসিয়াছে কেন, সে কথা আরও চমৎকার। —এখানে এত লোক এসেছে কেন তেওয়ারীজি ? —হজুর, সবাই বললে ফুলকিরার কাছান্ধিতে ম্যানেজার এসেছেন, সেখানে গেলে ভাত খেতে পাওয়া যাবে, তাই ওর এল, ওদের সঙ্গে আমিও এলাম । —ভাত এখানকার লোকে কি খেতে পায় না ? —কোথায় পাবে হুজুর। নউগচ্ছিয়ায় মাড়োয়ারীরা রোজ ভাত খায়, আমি নিজে আজ ভাত খেলাম বোধ হয় তিন মাস পরে। গত ভাদ্রমাসের সংক্রাস্তিতে রাসবিহারী সিং রাজপুতের বাড়ী নেমস্তয় ছিল, সে বড়লোক, ভাত খাইয়েছিল। তার পর আর থাই নি। যতগুলি লোক আসিয়াছিল, এই ভয়ানক শীতে কাহারও গাত্রবস্ত্র নাই, রাত্রে আগুন পোহাইয়া রাত কাটায়। শেষ রাত্রে শীত যখন বেশী পড়ে, আর ঘুম হয় না শীতের চোটে— আগুনের খুব কাছে ঘোষিরা বসিয়া থাকে ভোর পর্য্যন্ত ।