পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক ૨d বেল তিনটার সময়-জওয়াহিরলালের সাদা পাগড়ী রৌদ্রে চক্চক্ করিতেছে দেখা গেল। বাঙালী মুহুরীবাবু হাকিলেন—ম্যানেজারবাবু, আমুন, ডাকপেয়াদা আসছে—ঐ যে— আপিসের বাহিরে অসিলাম । ইতিমধ্যে জওয়াহিরলাল আবার ঢিবি হইতে নামিয়া জঙ্গলের মধ্যে চুবিয়া পড়িয়াছে। আমি অপেরাগ্রাস আনাইয়া দেখিলাম, দূরে জঙ্গলের মধ্যে দীর্ঘ দীর্ঘ ঘাসের ও বন-ঝাউয়ের মধ্যে সে আসিতেছে বটে। আর আপিসের কাজে মন বসিল না । সে কি আকুল প্রতীক্ষা ! যে জিনিস যত দুপ্রাপ্য মানুষের মনের কাছে তাহার-মূল্য তত বেশী। এ কথা খুবই সত্য যে, এই মূল্য মানুষের মনগড়া একটি কৃত্রিম মূল্য, প্রাধিত জিনিসের সত্যকার উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সঙ্গে এর কোনও সম্বন্ধ নাই। কিন্তু জগতের অধিকাংশ জিনিসের উপরই একটা কৃত্রিম মূল্য আরোপ করিয়াই তো আমরা তাকে বড় বা ছোট করি। g জওয়াহিরলালকে কাছারির সামনে একটা অপরিসর বালুময় নাবাল জমির ওপরে দেখা গেল। আমি চেয়ার ছাডিয়া উঠিলাম। মুহুরীবাবু আগাইয়া গেলেন। জওয়াহিরলাল আসিয়া সেলাম করিয়া দাড়াইল এবং পকেট হইতে চিঠির তাড়া বাহির করিয়া মুহুরী বাবুর হাতে দিল । بیر আমারও খান-দুই পত্র আছে—অতি পরিচিত হাতের লেখা। চিঠি পডিতে পড়িতে চারিপাশের জঙ্গলের দিকে চাহিয়া নিজেই অবাক হইয়া গেলাম। কোথায় আছি, কখনও ভাবি নাই আমি এখানে কোনদিন থাকিব, কলিকাতার আড্ডা ছাডিয়া এমন জায়গায় দিনের পর দিন কাটাইব । একথান বিলাতী ম্যাগাজিনের গ্রাহক হইয়াছি, আজ সেখান আসিয়াছে । মেডিকের উপরে লেখা "উড়ো জাহাজের ডাকে” । জনাকীর্ণ কলিকাতা শহরের বুকে বসিয়া বিংশ শতাব্দীর এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মুখ কি বুঝা যাইবে ? এখানে –এই নিজন বন-প্রদেশ—সকল বিষয়েই ভাবিবার ও অবাক হইবার অবকাশ আছে— এখানকার পারিপার্থিক অবস্থা সে-অনুভূতি অনিয়ন করে। যদি সত্য কথা বলিতে হয়, জীবনে ভাবিয়া দেথিবীর শিক্ষা এইখানে আসিয়াই পাইয়াছি। কত কথা মনে জাগে, কত পুবনে কথা মনে হয়—নিজের মনকে এমন করিয়া কখনও উপভোগ করি নাই। এখানে সহস্র প্রকার অসুবিধার মধ্যেও সেই আনন্দ আমাকে যেন একটা নেশার মত পাইয়া বসিতেছে দিন দিন । অথচ সত্যই আমি প্রশাস্ত মহাসমুদ্রের কোনও জনহীন দ্বীপে এক পরিত্যক্ত হই নাই। বোধ হয় বত্রিশ মাইলের মধ্যে রেল স্টেশন। সেখানে ট্রেনে চড়িয়া এক ঘণ্টার মধ্যে পূৰ্ণয়া যাইতে পারি—তিন ঘণ্টার মধ্যে মুঙ্গের যাইতে পারি। কিন্তু প্রথম তো রেলস্টেশনে যষ্টিতেই বেজায় কষ্ট—সে-কষ্ট স্বীকার করিতে পারি, যদি পূর্ণিয়া বা মুঙ্গের শহরে গিয়া কিছু লাভ থাকে। এমনি দেখিতেছি কোনও লাভই নাই, না আমাকে সেখানে কেউ চেনে, না আমি কাউকে চিনি। কি হইবে গিয়া ? কলিকাতা হইতে আসিয়া বই আর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গল্প ও আলোচনার অভাব এত