পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@8 বিভূতি-রচনাবলী ইহার পরে নিজের কাজে ধাওতাল সাহু অনেকবার কাছারিতে আমার সহিত দেখা করিয়াছে, প্রতিবার একটু একটু করিয়া তাহার সহিত আলাপ জমিয়া উঠিলে বুঝিলাম, একটি অতি অদ্ভুত লোকোত্তর চরিত্রের মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়াছে। বিংশ শতাব্দীতে এ ধরণের লোক যে আছে, না দেখিলে বিশ্বাস করা যায় না। ধাওতালের বয়স যাহা আন্দাজ করিয়াছিলাম, প্রায় তেষট্টি চৌষট্টি ! কাছারির পূর্ব-দক্ষিণ দিকের জঙ্গলের প্রান্ত হইতে বারো-তেরো মাইল দূরে নওগছিয়া নামে গ্রামে তাহার বাড়ী। এ অঞ্চলে প্রজা, জোতদার, জমিদার, ব্যবসাদার প্রায় সকলেই ধাওতাল সাহুর খাতক । কিন্তু তাহার মজা এই যে, টাকা ধার দিয়া সে জোর করিয়া কখনও তাগাদ করিতে পারে না । কত লোকে যে কত টাকা তাহার ফাকি দিয়াছে ! তাহার মত নিরীহ, ভালমানুষ লোকের মহাজন হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু লোকের উপরোধ সে এড়াইতে পারে না । বিশেষত: সে বলে, যখন সকলেই মোটা সুদ লিথিয়া দিয়াছে, তখন ব্যবসা হিসাবেও তো টাকা দেওয়া উচিত। একদিন ধাওতাল আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিল, উড়ানিতে বাধা এক বাণ্ডিল পুরনো দলিলপত্র। বলিল—হুজুর, মেহেরবানি করে একটু দেখবেন দলিলগুলো ? পরীক্ষা করিয়া দেখি প্রায় আট-দশ হাজার টাকার দলিল ঠিক সময়ে নালিশ না-করার দরুন তামাদি হুইয়া গিয়াছে । উড়ানির আর এক মুড়ে খুলিয়া সে অারও কতকগুলি জরাজীর্ণ কাগজ বাহির করিয়া বলিল—এগুলো দেখুন দেখি হুজুর। ভাবি একবার জেলায় গিয়ে উকীলদের দেখাই, তা মামলা কখনো করিনি, করা পোষায় না । তাগাদ করি, দিচ্ছি দেব করে টাকা দেয় না অনেকে । দেখিলাম, সবগুলিই তামাদি দলিল। সবসুদ্ধ জডাইয়া সেও চারপাঁচ হাজার টাকা। ভালমাছুষকে সবাই ঠকায় । বলিলাম—সাহুজী,মহাজনী করা তোমার কাজ নয়। এ-অঞ্চলে মহাজনী করতে পারবে রাসবিহারী সিং রাজপুতের মত দু দে লোকরা, যাদের সাত-আটট লাঠিয়াল আছে, খাতকের ক্ষেতে নিজে ঘোড করে গিয়ে লাঠিয়াল মোতায়েন করে আসে, ফসল ক্রোক করে টাক, আর সুদ আদায় করে । তোমার মত ভালমানুষ লোকের টাকা শোধ করবে না কেউ । দিও না কাউকে আর । ধাওতালকে বুঝাইতে পারিলাম না, সে বলিল—সবাই ফাকি দেয় না হুজুর। এখনও চন্দ্ৰ-সূৰ্য্য উঠছে, মাথার উপর দীন-দুনিয়ার মালিক এখনও আছেন। টাকা কি বসিয়ে রাখলে চলে, স্বদে না বাড়লে আমাদের চলে না হুজুর। এই আমাদের ব্যবসা । তাহার এ-যুক্তি আমি বুঝিতে পারিলাম না, মুদের লোভে আসল টাকা নষ্ট হইতে দেওয়া কেমনতর ব্যবসা জানি না। ধাওতাল সাহু আমার সামনেই অমান বদনে পনের-ষোল হাজার টাকার তামাদি দলিল ছিড়িয়া ফেলিল—এমন ভাবে ছিড়িল যেন সেগুলো বাজে কাগজ—অবশু, বাজে কাগজের পর্য্যায়েই তাহারা আসিয়া দাড়াইয়াছে বটে। তাহার হাত কপিল না, গলার মুর কঁাপিল না ।