পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ψυ विङ्कडि-ब्रध्नांबजैौ জয়পালের এই কথাটা আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিতাম না। আমি কলিকাতার কলেজে পড়িয়া মানুষ হইয়াছি, হয় কোন কাজ, নয়তো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আডড, নয় বই, নয় সিনেমা, নয় বেড়ানো—এ ছাড়া মানুষ কি করিয়া থাকে বুঝি না। ভাবিয়া দেখিতাম, দুনিয়ার কত কি পরিবর্তন হইয়া গেল, গত বিশ-বৎসর জয়পাল কুমার ওর ঘরের দোরটাতে ঠায় চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া তার কতটুকু খবর রাখে? আমি যখন ছেলেবেলায় স্কুলের নীচের ক্লাসে পড়িতাম, তখনও জয়পাল এমনি বসিয়া থাকিত, বি. এ. যখন পাস করিলাম তখনও জয়পাল এমনি করিয়া বসিয়া থাকে। আমার জীবনেরই নানা ছোট বড় ঘটনা যা আমার কাছে পরম বিস্ময়কর বস্তু, তারই সঙ্গে মিলাইয়া জয়পালের এই বৈচিত্র্যহীন নির্জন জীবনের অতীত দিনগুলির কথা ভাবিতাম । জয়পালের ঘরখানা গ্রামের একেবারে মাঝখানে হইলেও, কাছে অনেকটা পতিত জমি ও মকাই-ক্ষেত, কাজেই আশে-পাশে কোন বসতি নাই। ফুলকিয়া নিতান্ত ক্ষুদ্র গ্রাম, দশ-পনের ঘর লোকের বাস, সকলেই চতুৰ্দ্দিকৃব্যাপী জঙ্গলমহলে মহিষ চরাইয়া দিন গুজরান করে। সারাদিন ভূতের মত খাটে আর সন্ধ্যার সময় কলাইয়ের ভূষির আগুন জালাইয়া তার চারিপাশে পাড়ামৃদ্ধ বসিয়া গল্পগুজব করে, খৈন খায় কিংবা শালপাতার পিকার ধুম পান করে। হকায় তামাক খাওয়ার চলন এদেশে খুবই কম। কিন্তু কখনও কোন লোককে জয়পালের সঙ্গে আডডা দিতে দেখি নাই । প্রাচীন পাকুড় গাছটার মগডালে বকেরা দল বাধিয়া বাস করে, দূর হইতে দেখিলে মনে হয়, গাছের মাথায় থোক থোকা সাদা ফুল ফুটিয়াছে। স্থানটা ঘন ছায়াভরা, নির্জন, আর সেখানটাতে দাড়াইয়া যে দিকেই চোখ পড়ে, সে দিকেই নীল নীল পাহাড় দূরদিগন্তে হাত ধরাধরি করিয়া ছোট ছেলেমেয়েদের মত মওলাকারে দাড়াইয়া। আমি পাকুড় গাছের ঘন ছায়ায় দাড়াইয়া যখন জয়পালের সঙ্গে কথা বলিতাম, তখন আমার মনে এই সুবৃহৎ বৃক্ষতলের নিবিড় শাস্তি ও গৃহস্বামীর অমুদ্বিগ্ন, নিস্পৃহ, ধীর জীবনযাত্রা ধীরে ধীরে কেমন একটা প্রভাব বিস্তার করিত । ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইয়া লাভ কি ? কি মুন্দর ছায়া এই গুণম বংশী-বটের, কেমন মন্থর যমুনাজল, অতীতের শত শতাব্দী পায়ে পায়ে পার হইয়া সময়ের উজানে চলিয়া যাওয়া কি আরামের ! কিছু জয়পালের জীবনধাত্রার প্রভাব ও কিছু চারিধারের বাধা-বন্ধনশূন্ত প্রকৃতি আমাকেও ক্রমে ক্রমে যেন ঐ জয়পাল কুমারের মত নিৰ্ব্বিকার, উদাসীন ও নিস্পৃহ করিয়া তুলিতেছে। শুধু তাই নয়, আমার যে চোখ কখনও এর আগে ফুটে নাই সে চোপ যেন ফুটিয়াছে, যেসব কথা কখনও ভাবি নাই তাঁহাই ভাবাইতেছে। ফলে এই মুক্ত প্রান্তর ও ঘনশ্বামী অরণ্যপ্রকৃতিকে এত ভালবাসিয়া ফেলিয়াছি যে, একদিন পূর্ণিয়া কি মুঙ্গের শহরে কার্য্য উপলক্ষে গেলে মন উডু,উড়ু করে, মন টিকিতে চায় না। মনে হয়, কতক্ষণে জঙ্গলের মধ্যে ফিরিয়া যাইব, কতক্ষণে আবার সেই ঘন নির্জনতার মধ্যে, অপূৰ্ব্ব জ্যোৎস্নার মধ্যে, স্বৰ্য্যাস্তের মধ্যে, দিগন্তব্যাপী কালবৈশাখীর মেঘের মধ্যে, তারাভরা নিদাঘ-নিশীথের মধ্যে ডুব দিব !