পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক 8● উহার বলিল—এ বঁরণার কথা অনেকে জানে না হজুৰ, আমরা বনে জঙ্গলে হরবখত, বেডাই, আমরা জানি । আরও মাইল-পাচেক গিয়া কারো নদী পড়িল, খুব উচু বালির পাড় দু-ধারে, অনেকটা খাড়া নীচে নামিয়া গেলে তবে নদীর খাত, বৰ্ত্তমানে খুব সামান্তই জল আছে দু-পারে অনেক দূর পর্যন্ত বালুকাময় তীর ধূ-ধূ করিতেছে। যেন পাহাড হইতে নামিতেছে মনে হইল ; ঘোডীয় জল পার হইয়া যাইতে যাইতে এক জায়গায় ঘোডার জিন পৰ্য্যন্ত আসিয়া ঠেকিল, রেকবদলমুদ্ধ পা মুডিয়া অতি সন্তৰ্পণে পার হইলাম। ওপারে ফুটন্ত রক্তপলাশের বন, উচু-নীচ রাঙা-রাঙা শিলাখণ্ড, আর শুধুই পলাশ, আর পলাশ, সৰ্ব্বত্র পলাশ ফুলের মেলা। একবার দূরে একটা বুনো মহিষকে ধাতুপস্কুলের বন হইতে বাহির হইতে দেখিলাম—সেটা পাথরের উপর দাডাইয়া পায়ের খুর দিয়া মাটি খুডিতে লাগিল। ঘোডার মুখের লাগাম কষির থমকিয়া দাডাইলাম , ত্রিসীমানায় কোথাও জন-মানব নাই, যদি শিং পাতিয়া তাড়া করিয়া আসে ? কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, সেটা আবার পথের পাশের বনের মধ্যে চুকিয়া অদৃপ্ত হইয়া গেল । নদী ছাড়াইয়া আরও কিছুদূর গিয়া পথের দৃপ্ত কি চমৎকার! তবুও তো ঠিক-দুপুর বাঁ। বৰ্ণ কবিতেছে, অপরাহেব ছায়া নাই, রাত্রির জ্যোৎস্নালোক নাই—কিন্তু সেই নিস্তব্ধ খররৌদ্র-মধ্যাহ্নে বঁ-দিকে বনাবৃত দীর্ঘ শৈলমালা, দক্ষিণে লৌহপ্রস্তর ও পাইরোরাইট ছড়ানো উচুনীচু জমিতে শুধুই শুভ্রকাণ্ড গোলগোলি ফুলেব গাছ ও রাঙা ধাতুপফুলের জঙ্গল। সেই জায়গাটা সত্যিই একেবারে অদ্ভূত ; আমন রুক্ষ অথচ সুন্দর, পুষ্পাকীর্ণ অথচ উদাম ও অতিমাত্রায় বন্য ভূমিত্ৰ দেখিই নাই কখনও জীবনে। আব তার উপর ঠিক-দুপুরের খা-খ রৌদ্র । মাথার উপরের মাকাশ কি ঘন নীল । আকাশে কোথাও একটা পার্থী নাই, শূন্ত–মাটিতে বন্ত-প্রকৃতির বুকে কোথাও একটা মানুষ বা জীবজন্তু নাই—নিশৰ, ভয়ানক নিরালা। চারিদিকে চাহিয়া প্রকৃতি এই বিজন রূপলীলার মধ্যে ডুবিয়া গেলাম—ভারতবর্ষে এমন জায়গা আছে জনিতাম না তো ! এ যেন ফিলমে দেখা দক্ষিণ-আমেরিকার আরিজোনা বা নাভাজো মরুভূমি কিংবা হডসনের পুস্তকে বর্ণিত গিলা নদীর অববাহিকা-অঞ্চল। মেলায় পৌছিতে বেলা একটা বাজিয়া গেল । প্রকাণ্ড মেলা, যে দীর্ঘ শৈলশ্রেণী পথের বা-ধারে আমার সঙ্গে সঙ্গে ক্রোশ-তিনেক ধরিয়া চলিয়া আসিতেছিল, তারই সৰ্ব্বদক্ষিণ প্রান্তে ছোট্ট একটা গ্রামের মাঠে, পাহাডেব ঢালুতে চারিদিকে শাল পলাশের বনের মধ্যে এই মেলা বসিয়াছে। মহিষারডি, কড়ারী, তিনটাঙা, লছমনিয়াটােলা, ভীমদাসটোলা, মহলিখারূপ প্রভৃতি দূরের নিকটের নানা স্থান হইতে লোকজন, প্রধানত মেয়েরা আসিয়াছে। তরুণী, বন্ত মেয়েরা আসিয়াছে চুলে পিয়াল ফুল কি রাঙা ধাতুপফুল গুজিয়া ; কারে কারে মাথায় বাকী খোপার কাঠের চিরুণী আটকানো, বেশ স্বঠাম, সুললিত, লাবণ্যভরা দেহের গঠন প্রায় অনেক মেয়েরই—তারা আমোদ করিয়া খেলো পুতির দানার মালা, সস্তা জাপানী কি জার্মানীর সাবানের বাক্স, বাশি, আয়না, অতি বাজে এসেন্স কিনিতেছে, পুরুষেরা এক পয়সার