পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক 《 রাজু ভয়ে ভয়ে বলিল—সময় হুজুর বড় কম যে ! —কেন, কি কর সারাদিন ? রাজু লাজুক মুখে চুপ করিয়া রহিল। রাজুর বাসস্থান খুপরির মধ্যে জিনিসপত্রের বাহুল্য আদেী নাই। একটা লোটা ছাড অন্ত তৈজস চোখে পডিল না । লোটাটা বড়গোছের, তাতেই ভাত রান্না হয়। ভাত নয়, চীন ঘাসের বীজ। কাচ শালপাতায় ঢালিয়া সিদ্ধ চীনার বীজ খাইলে তৈজসপত্রে কি দরকার। জলের জন্য নিকটেই কুণ্ডী অর্থাৎ ক্ষুদ্র জলাশয় আছে। আর কি চাই । কিন্তু খুপ্ররির একধারে সিদ্ধবমাখানে ছোট কালো পাথরের রাধাকৃষ্ণমূৰ্ত্তি দেখিয়া বুঝিলাম, রাজু ভক্তমানুষ ! ক্ষুদ্র পাথরের বেদী বনের ফুলে সাজাইয়া রাখিয়াছে, বেদীর এক পাশে দু-একথানা পুথি ও বই। অর্থাৎ, তাহার সময় নষ্ট মানে সে সারাদিন পূজা-আচ্চা লইয়াই বোধ হয় ব্যস্ত থাকে। চাষ করে কখন ? এই রাজুকে প্রথম বুঝিলাম । রাজু পড়ে হিন্দী লেখাপডা জানে, সংস্কৃতও সামান্য জানে। তাও সে সৰ্ব্বদা পড়ে না. মাঝে মাঝে অবসর সময়ে গাছতলায় কি-একখানা হিন্দী বই খুলিয়া একটু বসে—অধিকাংশ সময় দূরের আকাশ ও পাহাডের দিকে চাহিয়া চুপচাপ বসিয়া থাকে। একদিন দেখি, একট ছোট থাতীয় খাগের কলমে, বসিয়া কি লিখিতেছে। ব্যাপার কি ? পাড়ে কবিতাও লেখে নকি ? কিন্তু সে এতই লাজুক, নীরব চাপা মানুষটি, তাহার নিকট হইতে কোন কথা বাহির করিয়া লওয়া বড় কঠিন। নিজের সম্বন্ধে সে কিছুই বলিতে চায় না। একদিন জিজ্ঞাসা করিলাম—পাড়েজী, তোমার বাড়ীতে আর কে আছে ? —সবাই আছে হুজুৰ, আমার তিন ছেলে, দুই লেড়কী, বিধবা বহিন । —তাদের চলে কিসে ? a রাজু আকাশের দিকে হাত তুলি য়া বলিল-ভগবান চালাচ্ছেন। তাদের দু-মুঠো পাওয়ানোর ব্যবস্থা করব বলেই তো হুজুরের আশ্রয়ে এসে জমি নিয়েছি। জমিট তৈরি করে ফেলতে পারলে— –কিন্তু দু-বিঘে জমির ফসলে অতবড় একটা সংসার চলবে? আর তাই বা তুমি উঠে পড়ে চেষ্টা করছ কই ? রাজু কথার জবাব প্রথমটা দিল না। তার পর বলিল—জীবনের সময়টাই বড় কম হুজুর! জঙ্গল কাটতে গিয়ে কত কথা মনে পড়ে, বসে বসে ভাবি । এই যে বন-জঙ্গল দেখছেন, বড় ভাল জায়গা। ফুলের দল কত কাল থেকে ফুটছে আর পাখী ডাকছে, বাতাসের সঙ্গে মিলে দেবতারা পৃথিবীর মাটিতে পা দেন এখানে । টাকার লোভ, পাওনাদেনার কাজ যেখানে চলে, সেখানকার বাতাস বিষিয়ে ওঠে ! সেখানে ওঁরা থাকেন না। কাজেই এখানে দা-কুড়ুল হাতে করলেই দেবতারা এসে হাত থেকে কেড়ে নেন—কানে চুপি চুপি এমন কথা বলেন, যাতে বিষয়-সম্পত্তি থেকে মন অনেক দূরে চলে যায়।