পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক (tఫి না ? তবে আমি কিছুদিন হোমিওপ্যাথি ওষুধ নাড়াচাড়া করিয়াছিলাম বটে, ভাবিলাম এই . সব ডাক্তার-কবিরাজশূন্ত স্থানে দেখি যদি কিছু উপকার করিতে পারি। কাছারি হইতে আমার সঙ্গে আরও অনেকে গেল। গ্রামে পৌঁছিয়া রাজু পাড়ের সঙ্গে দেখা হইল। সে একটা বাটুয়াতে শিকড়-বাকড জডি-ৰুটি লইয়া এ বাড়ী ও-বাড়ী রোগী দেখিয় বেড়াইতেছে। আমায় নমস্কার করিয়া বলিল—হুজুর । আপনার বডড দয়া, আপনি এসেছেন, এবার লোকগুলো যদি বাচে! এমন ভাবটা দেখাইল যেন আমি জেলার সিবিল সার্জন কিংবা ডাক্তার গুডিভ চক্রবর্তী। সে-ই আমাকে সঙ্গে করিয়া গ্রামে রোগীদের বাড়ী বাড়ী ঘুরাইয়া লইয়া বেড়াইল । রাজু ওষুধ দেয়, সবই দেখিলাম ধারে । সারিয়া উঠিলে দাম দিবে এই নাকি কড়ার হইয়াছে। কি ভয়ানক দারিদ্র্যের মূৰ্ত্তি কুটীরে কুটীরে ! সবই খোলীর কিংবা খডের বাড়ী, ছোট ছোট্ট ঘর, জানালা নাই, আলো-বাতাস ঢোকে না কোনো ঘরে। প্রায় সব ঘরেই দু-একটি রোগী, ঘরের মেঝেতে ময়লা বিছানার শুইয়া । ডাক্তার নাই, ওষুধ নাই, পথ্য নাই। অবশু রাজু সাধ্যমত চেষ্টা করিতেছে, না-ডাকিলেও সব রোগীর কাছে গিয়া তাহার জডি-বুটির ওষুধ খাওয়াইয়াছে, একটা ছোট ছেলের রোগশয্যার পাশে বসিয়া কাল নাকি সারা রাত সেবাও করিয়াছে। কিন্তু মডকের তাহাতে কিছুমাত্র উপশম দেখা যাইতেছে না, বরং বাডিয়াই চলিয়াছে। রাজু আমায় ডাকিয়া একটা বাড়ীতে লইয়া গেল। একখানা মাত্র খডের ঘর, মেঝেতে রোগী তালপাতার চেটাইয়ে শুইয়া, বয়েস পঞ্চাশের কম নয়। সতের-আঠারো বছরের একটি মেয়ে দোরের গোড়ায় বসিয়া হাপুম নয়নে কাদিতেছে। রাজু তাহাকে ভরসা দিয়া বলিল— কাদিস নে বোট, হুজুর এসে ন, আর ভয় নেই, রোগ সেরে যাবে। বডই লজ্জিত হইলাম নিজের অক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়া । জিজ্ঞাসা করিলাম—মেয়েটি বুঝি রোগীর মেয়ে ? রাজু বলিল—ন হুজুর, ওর বে। কেউ নেই সংসারে মেয়েটার, বিধবা মা ছিল, বিয়ে দিয়ে মারা গিয়েছে। একে বাচান হুজুর, নইলে মেয়েটা পথে বসবে! রাজুর কথার উত্তরে কি বলিতে যাইতেছি এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়িল রোগীর শিয়রের দিকে দেওয়ালে মেঝে থেকে হাত তিনেক উচুতে একটা কাঠের তাকের প্রতি। দেখি তাকের উপর একটা আঢাকা পাথরের থোরায় ছুটি পাস্ত ভাত। ভাতের উপর দু-দশটা মাছি বসিয়৷ আছে! কি সৰ্ব্বনাশ । ভীষণ এশিয়াটিক কলেরার রোগী ঘরে, আর রোগীর নিকট হইতে তিন হাতের মধ্যে ঢাকাবিহীন খোরায় ভাত ! সারাদিন রোগীর সেবা করার পরে দরিদ্র ক্ষুধাৰ্ত্ত বালিকা হয়তো পাথরের খোরাটি পাড়িয়া পান্ত ভাত দুটি হন লঙ্কা দিয়া আগ্রহের সহিত খাইতে বসিবে। বিষাক্ত অন্ন, যার প্রতি গ্রাসে নিষ্ঠুর মৃত্যুর বীজ! বালিকার সরল অশ্রুভরা চোখ দুটির দিকে চাহিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। রাজুকে বলিলাম—এ ভাত ফেলে দিতে বল ওকে। এ-ঘরে থাবার রাখে!