পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

● বিভূতি-রচনাবলী ভারি সুন্দর হাসি ওর মুখে । আর ওকে দেখিলেই মনে কেমন একটা অনুকম্প ও করুণার উদ্রেক হয়। সংসারে আপন বলিতে কেহ নাই, এই বয়সে নাচিয়া গাহিয়া পরের মন জোগাইরা পয়সা রোজগার করিতে হয়, তাও রাসবিহারী সিং-এর মত ধনগৰ্ব্বিত অরসিকদের গৃহ-প্রাঙ্গণে । জিজ্ঞাস করিলাম—এখানে তো অৰ্দ্ধেক রাত পৰ্য্যন্ত নাচতে গাইতে হবে, মজুরী কি পাবে ? ধাতুরিয়া বলিল-চার আনা পয়সা হুজুর, আর খেতে দেবে পেট ভরে। —কি খেতে দেবে ? 命 —মাঢ়ী, দই, চিনি। লাড ও দেবে বোধ হয়, আর বছর তো দিয়েছিল। আসন্ন ভোজ খাইবার লোভে ধাতুরিয়া খুব প্রফুল্ল হইয়া উঠিয়াছে। বলিলাম—সব জায়গায় কি এই মজুৰী ? ধাতুরিয়া বলিল—ন হুজুর, রাসবিহারী সিং বড়মানুষ, তাই চার আন দেবে আর খেতেও দেবে। গাঙ্গেীতাদের বাড়ী নাচলে দেয় দু-আনা, খেতে দেয় না, তবে আধ সের মকাইয়ের ছাতু দেয়। —এতে চলে ? —বাবু, নাচে কিছু হয় না, আগে হত । এখন লোকের কষ্ট, নাচ দেখবে কে। যখন নাচের বায়ন না থাকে, ক্ষেত খামারে কাজ করি। আর-বছর গম কেটেছিলাম। কি করি হুজুর, খেতে তো হবে। এত শখ করে ছক্করবাজি নাচ শিখেছিলাম গয়া থেকে—কেউ দেখতে চায় না, ছক্করবাজি নাচের মজুৰী বেশী । ধাতুরিয়াকে আমি কাছারিতে নাচ দেখাইবার নিমন্ত্ৰণ করিলাম। ধাতুরিয়া শিল্পী লোক —সত্যিকার শিল্পীর নিস্পৃহতা ওর মধ্যে আছে। পূর্ণিমার জ্যোৎস্না খুব ফুটিলে রাসবিহারী সিং-এর নিকট বিদার লইলাম। রাসবিহারী সিং পুনরায় দুটি বন্দুকের আওয়াজ করিল, আমার ঘোড়া উহাদের উঠান পার হইবার সঙ্গে সঙ্গে, আমার সম্মানের জন্ত । দোল-পূর্ণিমার রাত্রি। উদার, মুক্ত প্রান্তরের মধ্যে সাদা বালির রাস্তা জ্যোৎস্নাসম্পাতে চিকচিক্‌ করিতেছে। দূরে একটা সিল্লী পাখী জ্যোৎস্নারীতে কোথায় ডাকিতেছে-যেন এই বিশাল, জনহীন প্রস্তরের মধ্যে পথহারা কোন বিপন্ন নৈশ-পথিকের আকুল কণ্ঠস্বর। পিছন হইতে কে ডাকিল—হুজুর, ম্যানেজারবাবু— চাহিয়া দেখি ধাতুরিয়া আমার ঘোড়ার পিছু পিছু ছুটিতেছে। ঘোড়া থামাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—কি ধাতুরিয়া ? ধাতুরিয়া হাপাইতেছিল। একটুখানি দাড়াইয়া দম লইয়া, একটু ইতস্তুত করিয়া পরিশেষে লাজুক মুখে বলিল—একটা কথা বলছিলাম, হুজুর— তাহাকে সাহস দিবার সুরে বলিলাম—কি, বল না ? —হজুরের দেশে কলকাতায় আমায় একবার নিয়ে যাবেন ?