পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক S) সুমধুর বসন্ত কল্পনায় দেখিতাম, মনে পড়িত বাধানে পুকুরঘাটে স্বানান্তে আর্দ্রবস্ত্রে গমনরত কোন তরুণী বধূর ছবি, মাঠের ধারে ফুলকোটা ঘেটুবন, বাতাবী লেবুফুলের স্বগন্ধে মোহময় ঘনছায়া-ভরা অপরাতু। দেশকে কী ভাল করিয়াই চিনিলাম বিদেশে গিয়া ! দেশের জন্য এই মনোবেদন দেশে থাকিতে কখনও অনুভব করি নাই, জীবনে এ একটা বড় অনুভূতি, যে ইহার আস্বাদ না পাইল, সে হতভাগ্য একটা শ্রেষ্ঠ অনুভূতির সহিত অপরিচিত রহিয়া গেল । কিন্তু যে-কথাটা বার-বার নানা ভাবে বলিবার চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু কোন বারই ঠিকমত বুঝাইতে পারিতেছি না, সেটা হইতেছে এই প্রকৃতির একটা রহস্যময় অসীমতার, দুরধিগম্যতার, বিরাটত্বের ও ভয়াল গা-ছম্ছম-করানো সৌন্দর্য্যের দিকটা । না দেখিলে কি করিয়া বুঝাইব সে কী জিনিস। জনশূন্ত বিশাল লবটুলিয়া বইহারের দিগন্তব্যাপী দীর্ঘ বনবাউ ও কাশের বনে নিস্তব্ধ অপরাহ্লে এক ঘোড়ার উপর বসিয়া এথানকার প্রকৃতির এই রূপ আমার সারা মনকে অসীম রহস্যমুভূতিতে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছে, কখনও তাহ আসিয়াছে ভয়ের রূপে, কখনও আসিয়াছে একটা নিস্পৃহ, উদাস, গভীর মনোভাবের রূপে, কখনো আসিয়াছে কত মধুময় স্বপ্ন, দেশ-বিদেশের নর-নারীর বেদনার রূপে । সে যেন খুব উচ্চদরের নীরব সঙ্গীত— নক্ষত্রের ক্ষীণ আলোর তালে, জ্যোৎস্নারাত্রের অবাস্তবতায়, ঝিল্লীর তানে, ধাবমান উল্কার অগ্নিপুচ্ছের জ্যোতিতে তার লয়-সঙ্গতি। সে-রূপ তাহার না-দেখাই ভাল যাহাকে ঘরদুয়ার বাধিয়া সংসার করিতে হইবে। প্রকৃতির সে মোহিনীরূপের মায়া মানুষকে ঘরছাড়া করে, উদাসীন ছন্নছাড়া ভবঘুরে হ্যারি জনস্টন, মার্কে পোলো, হাড়-সন, খ্যাকলটন করিয়া তোলে—গৃহস্থ সাজিয়া ঘরকান্না করিতে দের না— অসম্ভব তাহার পক্ষে ঘরক. কর একবার সে ডাক যে শুনিয়াছে, সে অনবগুষ্ঠিত মোহিনীকে একবার যে প্রত্যক্ষ করিয়াছে। গভীর রাত্রে ঘরের বাহিরে এক আসিয়া দাড়াইয়া দেখিয়াছি, অন্ধকার প্রাস্তরের অথবা ছায়াহীন ধূ-ধূ জ্যোৎস্না-ভরা রাত্রির রূপ। তার সৌন্দর্ঘ্যে পাগল হইতে হয়—একটুও বাড়াইয়া বলিতেছি না—আমার মনে হয় দুৰ্ব্বলচিত্ত মানুষ যাহারা, তাহীদের পক্ষে সে-রূপ না দেখাই ভাল, সৰ্ব্বনাশী রূপ সে, সকলের পক্ষে তার টাল সামলানো বড় কঠিন । তবে একথাও ঠিক, প্রকৃতিকে সে শ শ দেখাও ভাগ্যের ব্যাপার। এমন বিজন বিশাল উন্মুক্ত অরণ্য-প্রাস্তরে, শৈলমালা, বনঝাউ, আর কাশের বন কোথায় যেখানে-সেখানে ? তার সঙ্গে যোগ চাই গভীর নিশীথিনীর নীরবতার ও তার অন্ধকার বা জ্যোৎস্নার-এত যোগাযোগ মুলভ হইলে পৃথিবীতে, কবি আর পাগলে দেশ ছাইয়া যাইত না ? একদিন প্রকৃতির সে-রূপ কি-ভাবে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলাম, সে-ঘটনা বলি। পূর্ণিয়া হইতে উকিলের 'তার' পাইলাম পরদিন সকালে দশটার মধ্যে আমায় সেখানে হাজির হইতে হইবে। অন্যথায় স্টেটের একটা বড় মোকদ্দমায় আমাদের হার সুনিশ্চিত ।