পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૧8 বিভূতি-রচনাবলী আমাদের মহাল হইতে পূর্ণিয় পঞ্চান্ন মাইল দূরে। রাত্রের ট্রেন মাত্র একখানি, যখন ‘তার হস্তগত হইল তখন সতের মাইল দূরবর্তী কাটারিয়া স্টেশনে গিয়া সে-ট্রেন ধরা অসম্ভব। ঠিক হইল এখনই ঘোড়ায় রওনা হইতে হইবে। কিন্তু পথ সুদীর্ঘ বটে, বিপদসঙ্কুলও বটে, বিশেষ করিয়া এই রাত্রিকালে, এই অরণ্যঅঞ্চলে। সুতরাং তহশীলদার মুজন সিং আমার সঙ্গে যাইবে ইহাও ঠিক হইল। সন্ধ্যায় দুজনে ঘোড়া ছাড়িলাম। কাছারি ছাড়িয়া জঙ্গলে পড়িতেই কিছু পরে কৃষ্ণ তৃতীয়ার চাদ উঠিল। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় বন-প্রান্তর আরও অদ্ভুত দেখাইতেছে। পাশাপাশি দু'জনে চলিয়াছি—আমি আর সুজন সিং । পথ কখনও উচু, কখনও নীচু, সাদা বালির উপর জ্যোৎস্না পড়িয়া চক্চকু করিতেছে। ঝোপঝাপ মাঝে মাঝে, আর শুধু কাশ আর ঝাউবন চলিয়াছে, সুজন সিং গল্প করিতেছে। জ্যোৎস্না ক্রমেই ফুটিতেছে—বনজঙ্গল, বালুচর, ক্রমশ: স্পষ্টতর হইতেছে। বহুদূর পর্য্যস্ত নীচু জঙ্গলের শীর্ষদেশ একটানা সরল রেখায় চলিয়া গিয়াছে—যতদূর দৃষ্টি যার ধুধু প্রান্তর একদিকে, অন্ত দিকে জঙ্গল। বা দিকে দূরে অনুচ্চ শৈলমালা। নির্জন, নীরব, মানুষের বসতি কুত্ৰাপি নাই, সাড়া নাই, শব্দ নাই, যেন অন্ত কোন অজানা গ্রহের মধ্যে নির্জন বনপথে দুটি মাত্র প্রাণী আমরা। -- এক জায়গায় মুজন সিং ঘোড়া থামাইল। ব্যাপার কি ? পাশের জঙ্গল হইতে একটি ধাড়ী বক্তশূকর একদল ছানাপোনা লইয়া আমাদের পথ পার হইয়া বা দিকের জঙ্গলে ঢুকিতেছে। স্বজন সিং বলিল—তবুও ভাল হুজুর, ভেবেছিলাম বুনো মহিষ । মোহনপুর জঙ্গলের কাছে আসিয়া পড়িয়াছি, বুনো মহিষের ভয় এখানে খুব । সেদিনও একজন লোক মারিয়াছে মহিষে । আরও কিছুদূর গিয়া জ্যোৎস্নায় দূর হইতে কালোমত সত্যই কি-একটা দেখা গেল। স্বজন বলিল—ঘোড়া ভয় পাবে হুজুর, ঘোড়া রুখুন। শেষে দেখা গেল সেটা নড়েও না চড়েও না! একটু একটু করিয়া কাছে গিয়া দেখা গেল, সেটা একটা কাশের খুপ্ররি। আবার ঘোড়া দুটাইয়া দিলাম। মাঠ-ঘাট, বন, ধুধু জ্যোৎস্না-ভরা বিশ্ব—কি একটা সঙ্গীহারা পার্থী আকাশের গায়ে কি বনের মধ্যে কোথায় ভাকিতেছে টি-টি-টি-টি-ঘোড়ার খুরে বড় বালি উঠতেছে, ঘোড়া একমুহূৰ্ত্ত থামাইবার উপায় নাই—উড়াও, উড়াও— অনেকক্ষণ একভাবে বসিয়া পিঠ টন টন্‌ করিতেছে, জিনের বসিবার জায়গাটা গরম হইয়া উঠিয়াছে, ঘোড়া ছাড়তোক ভাঙিয়া দুলকি চাল ধরিয়াছে, আমার ঘোড়াটা আবার বড় ভয় পায়, এজন্য সতর্কতার সঙ্গে সামনের পথে অনেক দূর পর্য্যন্ত নজর রাখিয়া চলিয়াছিহঠাৎ থমকিয়া ঘোড় দাড়াইয়া গেলে ঘোড়া হইতে ছিটকাইয়া পড়া অনিবাৰ্য্য। কাশের মাথায় ঝুটি বাধিয়া জঙ্গলে পথ ঠিক করিয়া রাখিয়াছে, রাস্ত বলিয়া কিছু নাই, সেই কাশের ঝুটি দেখিয়া এই গভীর জঙ্গলে পথ ঠিক করিয়া লইতে হয়। একবার স্বজন সিং বলিল—হজুর, এ-পথটা যেন নয়, পথ ভুলেছি আমরা।