পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক , ጫእ বন বিশাল সরস্বতী কুণ্ডীর নীল জলকে তিনদিকে অৰ্দ্ধচন্দ্রাকারে ঘিরিয়া রাখিয়াছে, একদিকে কাকা-সেখান হইতে পূৰ্ব্বদিকের বহুদূর-প্রসারিত নীল আকাশ ও দূরের শৈলমাল চোখে পড়ে। সুতরাং পূৰ্ব্ব-পশ্চিম কোণের তীরের কোন-এক জায়গায় বসিয়া দক্ষিণ ও বাম দিকে চাহিয়া দেখিলে সরস্বতী কুঞ্জীর সৌন্দর্ঘ্যের অপূৰ্ব্বতা ঠিক বোঝা যায়। বামে চাহিলে গভীর হইতে গভীরতর বনের মধ্যে দৃষ্টি চলিয়া গিয়া ঘন নিবিড় শুামলতার মধ্যে নিজেকে নিজে হারাইরা ফেলে, দক্ষিণে চাহিলে স্বচ্ছ নীল জলের ওপারে সুদূরবিসপী আকাশ ও অস্পষ্ট শৈলমালার ছবি মনকে বেলুনের মত ফুলাইয়া পৃথিবীর মাটিতে উড়াইয়া লইয়া চলে। এখানে একখানা শিলাখণ্ডের উপর কতদিন গিয়া একা বসিয়া থাকিতাম । কখনও বনের মধ্যে দুপুরবেলা আপন মনে বেড়াইতাম। কত বড় বড় গাছের ছায়ায় বসিয়া পাখীর কুজন শুনিতাম। মাঝে মাঝে গাছপালা, বন্তলতার ফুল সংগ্ৰহ করিতাম। এখানে যত রকমের পার্থীর ডাক শোনা যায়, আমাদের মহলে অত পাখী নাই। নানা রকমের বন্ত ফল খাইতে পায় বলিয়া এবং সম্ভবতঃ উচ্চ বনস্পতিশিরে বাসা বাধিবার সুযোগ ঘটে বলিয়া সরস্বতী কুন্ত্রীর তীরের বনে পার্থীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশী। বনে ফুলও অনেক রকমের ফোটে। হ্রদের তীরের নিবিড় বন প্রায় তিন মাইলের উপর লম্বা, গভীরতায় প্রায় দেড় মাইল । জলের ধার দিয়া বনের মধ্যে গাছপালার ছায়ায় ছায়ায় একটা মুড়ি পথ বনের শুরু হইতে শেষ পৰ্য্যস্ত আসিয়াছে—এই পথ ধরিয়া বেড়াইতাম। গাছপালার ফঁাকে ফঁাকে মাঝে মাঝে সরস্বতীর নীল জল, তার উপর উপুড়-হইয়া-পড়া দূরের আকাশটা এবং দিগন্তলীন শৈলশ্রেণী চোখে পড়িত। ঝিবুঝির করিয়া স্নিগ্ধ হাওয়া বহিত, পাখী গান গাহিত, বন্ত ফুলের মুগন্ধ পাওয়া য ইত। একদিন একটা গাছের ডালে উঠিয়া বসিলাম। সে-আনন্দের তুলনা হয় না। আমার মাথার উপরে বিশাল বন পতিদলের ঘন সবুজ পাতার রাশি, তার ফঁাকে ফঁাকে নীল আকাশের টুকরা, প্রকাও একটা লতায় থোকা থোকা ফুল ফুলিতেছে। পায়ের দিকে অনেক নীচে ভিজা মাটিতে বড় বড় ব্যাঙের ছ।৩। গজাইয়াছে। এখানে আসিয়া বসিয়া শুধু ভাবিতে ইচ্ছা হয়। কত ধরণের কত নব অনুভূতি মনে আসিয়া জোটে। এক প্রকার অতল সমাহিত অতিমানস চেতনা ধীরে ধীরে গভীর অস্তস্তল হইতে বাহিরের মনে ফুটিয়া উঠিতে থাকে। এ আসে গভীর আনন্দের মূৰ্ত্তি ধরিয়া। প্রত্যেক বৃক্ষলতার হৃৎস্পন্দন যেন নিজের বুকের রক্তের স্পন্দনের মধ্যে অমুভব করা যায়। আমাদের যেখানে মহাল, সেখানে পাখীর এত বৈচিত্র্য নাই। সেখানটা যেন অন্ত জগৎ, তার গাছপালা, জীবজন্তু অন্য ধরণের। পরিচিত জগতে বসন্ত যখন দেখা দিয়াছে, লবটুলিয়ার তখন একটা কোকিলের ডাক নাই, একটা পরিচিত বসত্তের ফুল নাই। সে যেন রুক্ষ কর্কশ ভৈরবী মূৰ্ত্তি ; সৌম্য, মুন্দর বটে, কিন্তু মাধুর্য্যহীন—মনকে অভিভূত করে ইহার বিশালতায়, রুক্ষতার। কোমল বর্জিত খাড়ব মুর, মালকোষ কিংবা চোতালের ধ্রুপদ, মিষ্ট্রত্বের কোন পর্দার ধার মাড়াইয়া চলে না—স্বরের গম্ভীর উদাত্তরূপে মনকে অন্ত এক স্তরে লইয়া পৌছাইয়া দেয়। "