পাতা:বিভূতি রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড).djvu/৪০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বেলীগীর ফুলবাড়ী רישש আসিয়া পৌছিতে লাগিল। সেই পাকা সোনার ধানক্ষেত-নিস্তৰ সোনাদীঘি, জাশেপাশে তালের বন, সবুজ র্যাশের ঝাড়, হলদে পাতায় ভরা বনপথ, মর্শ্বর শঙ্ক, হাস্তোজ্জল শিমূল গাছ, চিকন পত্র-শোভিত তেঁতুল গাছ, সব কিছু মিলিয় তাহার নিকট অপূর্ব শোভা ধারণ করিল। সেই যে প্রতিদিন পাঠশালা হইতে ফিরিবার সময়ে পথের ধারের ককে ফুল হইতে মধু চুষিয়া খাইত সেটিই যেন আজ তাহার নিকট বড় প্রয়োজনীয় বলিয়া বোধ হইল। তাহার সোনার দেশ, সোনার মাটি। ইছামতীর ধীর কলধ্বনি, দু-একখানি জেলে ভিঙ্গি, সন্ধ্যায় কম্পমান জলের উপর সহস্ৰ স্বৰ্য্যমূৰ্ত্তি, নিঃশঙ্ক প্রকৃতি, তাহার নিকট বড়ই মধুর বোধ হইল। তাহার মার কথা মনে পড়িল, সেই স্নেহময়ী জননী। দুঃখিনী কত আশা করিয়াই না তাহাকে শহুরে পাঠাইয়াছিলেন। যদি তিনি ঘূণাক্ষরেও জানিতেন শহর কি বিষাক্ত, কি বিত্র, কি বিস্বাদ! মার কথা মনে পড়িতেই গোবিন্দ কাদিয়া ফেলিল। অশ্র আর সে রোধ করিতে পারিল না। আজ তাহার জন্মদিন । ভাদ্র মাসে এক শুক্রবারে তাহার জন্ম। এই দিন মা তাহাকে পরমান্ন রাধিয়া দেন, খাইবার সময়ে তাহার সামনে প্রদীপ জালিয়া দেন, শাখ বাজান । আজ তাহার জীবনের একটি বিশেষ দিন। ভাদ্র মাসের এই শেষ শুক্রবার। এ বৎসর তাহার জন্মদিন বৃথাই কাটিল। কতদিন সে তার মীর সংবাদ পায় নাই। তিনি কেমন আছেন তাহা জানিবার জন্য তাহার মন সহসা ব্যাকুল হই উঠিল। সন্ধ্যায় পড়িবার সময় তাহার অতিবাহিত হইতেছে। না, সে আজ আর পড়িতে যাইবে না। সেই তো ছোট ঘরখানিতে বসিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতে হইবে। এতটুকু থামিবার অবকাশ নাই, তাহা হইলেই মাস্টারের শাসনদও। সেই বিশ্ৰী ট্র্যান্সলেশন, সেই উৎকট গ্রামের কসরৎ । এসব কিছু তাহার ভাল লাগে না । না, সে লেখাপড় শিখিতে চায় না । এইরূপ কত কি আকাশ-পাতাল ভাবিতে ভাবিতে কখন সে নিজের অজ্ঞাতসারে ঘুমাইয়া পড়িল। কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিল তাহা জ্বশ নাই, সে স্বপ্ন দেখিল, সে যেন দেশে ফিরিয়া গিয়াছে । তাহার মা যেন বকিতেছেন, কেন এলি ? বেশ তো ছিলি! তিনি জানেন না তো তাহার ছেলে কি স্বখে আছে । জানিলে তিনি নিশ্চয় গোবিন্দকে এই মরুভূমিতে পাঠাইয়া চুপ করিয়া থাকিতে পারিতেন না। তাহার যখন ঘুম ভাঙিল তখন কত রাত্রি তাহা বুঝিতে পারিল না। কেবল এইটুকু বুঝল, রাত্রি গভীর হইয়াছে। সকলেই যে যার গৃহে নিঃশবে পড়িয়া ঘুমাইতেছে। তাহাকে কেহই পড়িতে বা খাইতে ডাকে নাই। না কাক না কাকী । এমন সময়ে নিকটের গীর্জার ঘড়িতে স্বর করিয়া পাচটা বাজিয়া গেল । গোবিন্দ তাহার চক্ষু মুছিল। ওঃ, রাত্রি তো ভোর হইল প্রায়। এই পাচটার পর ছয়টায় তাহাদের দেশের একটি ট্রেন আছে। বাড়ীর কথা মনে পড়িতেই সে সহসা উঠিয়া বসিল । ন, সে আর এখানে থাকিবে না। সে এই ছয়টার গাড়ীতেই দেশে ফিরিয়া যাইবে । চুপিচুপি তাহার ছোট ক্যাশ-বাক্সটি লইয়া বাহির হইয়া পড়িল আসিবার সময়ে এই বাক্সটি তাহাকে তাহার মা দিয়াছিলেন।