পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাজবৌ
১১

কাছে বসিয়া ধীরে ধীরে পাখার বাতাস করিতেছিল। অনতিকাল পরে স্নান করিয়া বিরাজ সিক্ত চুল পিঠের উপর ছড়াইয়া দিয়া পট্টবস্ত্র পরিয়া ঘরে ঢুকিল। সমস্ত ঘর যেন আলো হইয়া উঠিল। নীলাম্বর চাহিয়া দেখিয়া বলিল, ও কি?

 বিরাজ বলিল, যাই, বাবা পঞ্চানন্দের পুজো পাঠিয়ে দিই গে, বলিয়া শিয়রের কাছে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া হাত দিয়া স্বামীর কপালের উত্তাপ অনুভব করিয়া বলিল, না জ্বর নেই। জানিনে এবছর মার মনে কি আছে। ঘরে ঘরে কি কাণ্ড যে শুরু হয়েছে—আজ সকালে শুনলাম, আমাদের মতি মোড়লের ছেলের সর্বাঙ্গে মার অনুগ্রহ হয়েছে—দেহে তিল রাখবার স্থান নেই।

 নীলাম্বর ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, মতির কোন্ ছেলের বসন্তু দেখা দিয়েছে?

 বড়ছেলের। মা শীতলা, গাঁ ঠাণ্ডা কর মা। আহা ঐ ছেলেই ওর রোজগারী। গেল শনিবারের শেষ-রাত্তিরে ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ তোমার গায়ে হাত পড়ায় দেখি, গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। ভয়ে বুকের রক্ত কাঠ হয়ে গেল। উঠে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলুম, তার পরে মানস করলুম, মা শীতলা, ভাল যদি কর মা, তবেই তো তোমার পুজো দিয়ে আবার খাবদাব, না হলে অনাহারে প্রাণত্যাগ করব।

 বলিতে বলিতে তাহার দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হইয়া দুফোঁটা জল পড়িল। নীলাম্বর আশ্চর্য হইয়া বলিল, তুমি উপোস করে আছ নাকি?

 হরিমতি কহিল, হাঁ দাদা, কিছু খায় না বৌদি—কেবল সন্ধ্যেবেলায় এক মুঠো কাঁচা চাল আর এক ঘটি জল খেয়ে আছে—কারও কথা শোনে না।

 বিরাজ আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, পাগলামি নয়? আসল পাগলামি! মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাতে ত বুঝতে, স্বামী কি বস্তু। তখন বুঝতে, এমন দিনে তার জ্বর হলে, বুকের ভিতরে কি করতে থাকে। বলিয়া উঠিয়া যাইতেছিল, দাঁড়াইয়া বলিল, পুঁটি, ঝি পুজো নিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে যাস ত যা, শিগগির করে নি গে।

 পুঁটি আহ্লাদে দাঁড়াইয়া বলিল, যার বৌদি।

 তবে দেরি করিস নে, যা। ঠাকুরের কাছে তোর দাদার জন্যে বেশ করে বর চেয়ে নিস।

 পুঁটি ছুটিয়া চলিয়া গেল।

 নীলাম্বর হাসিয়া বলিল, সে ও পারবে। বরং তোমার চেয়ে ওই ভাল পারবে।

 বিরাজ হাসিমুখে ঘাড় নাড়িল। বলিল, তা মনে ক’রো না। ভাই বল আর বাপ-মাই বল, মেয়ে মানুষের স্বামীর বড় আর কেউ নয়। ভাই বাপ-মা গেলে দুঃখ কষ্ট খুবই হয়, কিন্তু স্বামী গেলে যে সর্বস্ব যায়। এই যে পাঁচদিন না খেয়ে আছি, তা, দুর্ভাবনার চাপে একবার মনে হয়নি যে উপোস করে আছি—কিন্তু