পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২
বিরাজবৌ

কৈ, ডাক ত তোমার কোন বোনকে দেখি কেমন—

 নীলাম্বর তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিল, আবার!

 বিরাজ বলিল, তবে বল কেন? পাগলামি করেচি সে আমি জানি, আর যে দেবতা আমার মুখে রেখেচেন, তিনিই জানেন। আমি ত তাহলে একটি দিনও বাঁচতুম না, সিঁথির এ সিঁদুর তোলবার আগে এ সিঁথে পাথর দিয়ে চেঁচে ফেলতুম। শুভযাত্রা করে লোকে মুখ দেখবে না, শুভকর্মে লোকে ডেকে জ্ঞিজ্ঞেস করবে না, এ দুটো শুধুহাত লোকের কাছে বার করতে পারব না, লজ্জায় এ মাথায় আঁচল সরাতে পারব না, ছি ছি, সে বাঁচা কি আবার একটা বাঁচা? সেকালে যে পুড়িয়ে মারা ছিল, সে ছিল ঠিক কাজ। পুরুষমানুষে তখন মেয়েমানুষের দুঃখ-কষ্ট বুঝতো, এখন বোঝে না।

 নীলাম্বর কহিল, না, তুই বুঝিয়ে দি গে।

 বিরাজ বলিল, তা পারি। আর শুধু আমিই কেন, তোমাকে পেয়ে যে-কেউ তোমাকে হারাবে, সেই বুঝিয়ে দিতে পারবে—আমি একলা নয়। যাক, কি সব বকে যাচ্ছি, বলিয়া হাসিয়া উঠিল। তার পর ঝুঁকিয়া পড়িয়া আর একবার স্বামীর বুকের উত্তাপ হাত দিয়া অনুভব করিয়া বলিল, গায়ে কোথাও ব্যথা নেই ত?

 নীলাম্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

 বিরাজ বলিল, তবে আর কোন ভয় নাই। আজ আমার ক্ষিদে পেয়েছে—যাই এইবার দুটো রাঁধবার যোগাড় করি গে—সত্যি বলছি তোমাকে, আজ কেউ যদি আমার একখানা হাত কেটে দেয়, তাহলেও বোধ করি রাগ হয় না।

 যদু চাকর বাহির হইতে ডাকিয়া বলিল, মা, কবিরাজমশাইকে এখন ডেকে আনতে হবে কি?

 নীলাম্বর কহিল, না না, আর আবশ্যক নেই।

 যদু তথাপি গৃহিণীর অনুমতির জন্য দাঁড়াইয়া রহিল।

 বিরাজ তাহা দেখিতে পাইয়া বলিল, না? যা ডেকে নিয়ে আয়, একবার ভাল করে দেখে যান।

দিন-তিনেক পরে আরোগ্যলাভ করিয়া নীলাম্বর বাহিরে চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া ছিল, মতি মোড়ল আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল—দাদাঠাকুর, তুমি একবার না দেখলে ত আমার ছিমস্ত আর বাঁচে না। একবার পায়ের ধুলো দাও দেবতা, তাহলে যদি এযাত্রা সে বেঁচে—। আর সে বলিতে পারিল না—আকুলভাবে কাঁদিতে লাগিল।

 নীলাম্বর জিজ্ঞাসা করিল, গায়ে কি খুব বেশী বেরিয়েচে মতি? মতি চোখ মুছিতে মুছিতে বলিতে লাগিল, সে আর কি বলব। মা যেন একেবারে ঢেলে দিয়েচেন। ছোটজাত হয়ে জন্মেচি ঠাকুদ্দা, কিছুই ত জানি নে কি করতে হয়—একবার চল, বলিয়া সে দু’পা জড়াইয়া ধরিল।

 নীলাম্বর ধীরে ধীরে পা ছাড়াইয়া লইয়া কোমলস্বরে বলিল, কিছু ভয় নেই মতি,