পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তিন

 বছর তিনেক পরের কথা বলিতেছি। মাস দুই পূর্বে হরিমতি শ্বশুরঘর করিতে গিয়াছে; ছোটভাই পীতাম্বর এক বাটীতে থাকিয়াও পৃথক হইয়াছে। বাহিরের চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দার সন্ধ্যার ছায়া সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। সেইখানে নীলাম্বর একটা ছেঁড়া মাদুরের উপর চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। বিরাজ নিঃশব্দে আসিয়া কাছে দাঁড়াইল। নীলাম্বর চাহিয়া দেখিয়া বলিল, হঠাৎ বাইরে যে?

 বিরাজ একধারে বসিয়া পড়িয়া বলিল, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।

 কি?

 বিরাজ বলিল, কি খেলে মরণ হয় বলে দিতে পার?

 নীলাম্বর চুপ করিয়া রহিল।

 বিরাজ পুনরায় কহিল, হয় বলে দাও, না হয় আমাকে খুলে বল, কেন এমন রোজ রোজ ঢুকিয়ে যাচ্চ।

 শুকিয়ে যাচ্ছি কে বললে?

 বিরাজ চোখ তুলিয়া এক মূহূর্তে স্বামীর মুখের পানে চাহিল, তারপরে বলিল, হাঁ গা, কেউ বলে দেবে তবে আমি জানব, এ কি সত্যিই তোমার মনের কথা?

 নীলাম্বর একটুখানি হাসিল। নিজের কথাটা সামলাইয়া লইয়া বলিল, না রে, তা নয়। তবে তোর নাকি বড় ভুল হয়—তাই জিজ্ঞেস কচ্চি; এ কি আর কেউ বলেচে, না নিজেই ঠিক করেচিস?

 বিরাজ এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও প্রয়োজন বিবেচনা করিল না। বলিল, কত বললুম তোমাকে পুঁটির আমার অমন জায়গায় বিয়ে দিও না—কিছুতেই কথা শুনলে না। নগদ যা ছিল গেল, আমার গায়ের গয়নাগুলো গেল, যদু মোড়লের দরুন ডাঙ্গাটা বাঁধা পড়ল, দুখানা বাগান বিক্রি করলে, তার উপর এই দু সন অজন্মা। বল আমাকে, কি করে তুমি জামাইয়ের পড়ার খরচ মাসে মাসে যোগাবে? একটা কিছু হলেই পুঁটিকে খোঁটা সইতে হবে—সে আমার অভিমানী মেয়ে, কিছুতেই তোমার নিন্দে শুনতে পারবে না—শেষে কি হতে কি হবে ভগবান জানেন—কেন তুমি এমন কাজ করলে?

 নীলাম্বর মৌন হইয়া রহিল। বিরাজ বলিল, তা ছাড়া পুঁটির ভাল করতে গিয়ে দিনরাত ভেবে ভেবে যে শেষে তুমি আমার সর্বনাশ করবে, সে হবে না। তার চেয়ে এক কাজ কর, দু-পাঁচ বিঘে জমি বিক্রি করে শ-পাঁচেক টাকা যোগাড় করে গঙ্গায় কাপড় দিয়ে