পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাজবৌ
১৭

জামাইয়ের বাপকে বল গে, এই নিয়ে আমাদের রেহাই দিন মশাই, আমরা গরীব, আর পারব না। এতে ভালমন্দ পুঁটির অদৃষ্টে যা হয় তা হোক।

 তথাপি নীলাম্বর মৌন হইয়া রহিল।

 বিরাজ মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, পারবে না বলতে?

 নীলাম্বর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, পারি, কিন্তু সবই যদি বিক্রি করে ফেলি বিরাজ, আমাদের হবে কি?

 বিরাজ বলিল, হবে আবার কি! বিষয় বাঁধা দিয়ে মহাজনের সুদ আর মুখনাড়া সহ্য করার চেয়ে এ ঢের ভালো। আমার একটা ছেলেপিলে নেই যে তার জন্য ভাবনা—আমরা দুটো প্রাণী—যেমন করে হোক চলে যাবেই। নিতান্ত না চলে, তুমি বোষ্টমঠাকুর ত আছই, আমি না হয় বোষ্টমী হয়ে পড়ব—দুজনে বৃন্দাবন করে বেড়াব।

 নীলাম্বর একটুখানি হাসিয়া বলিল, তুই কি করবি, মন্দিরা বাজাবি?

 হুঁ বাজাব। নেহাত না পারি, তোমার ঝুলি বয়ে বেড়াতে পারব ত! তোমার মুখের কৃষ্ণনাম শুনে পশু-পক্ষী স্থির হয়ে দাঁড়াবে, আমাদের দুটো প্রাণীর খাওয়া চলবে না? চল, ঘরে চল, অন্ধকারে তোমার মুখ দেখতে পাচ্চিনে।

 ঘরে আসিয়া বিরাজ স্বামীর মুখের কাছে প্রদীপ তুলিয়া আনিয়া ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া হাসি গোপন করিয়া বলিল, না সাহস হয় না, এমন বোষ্টমটিকে আর পাঁচজন বোষ্টমীর সামনে প্রাণ ধরে বার করতে পারব না—তার চেয়ে এখানে শুকিয়ে মরি সে ভাল।

 নীলাম্বর হাসিয়া উঠিল। বলিল, ওরে সেখানে শুধু বোষ্টমীই থাকে না, বোষ্টমও থাকে।

 বিরাজ বলিল, তা থাক। একজন দুজন কেন, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ থাক,—বলিয়া প্রদীপটা যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া পায়ের কাছে বসিয়া পড়িয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, আচ্ছা, শুনি সংসারে সতী অসতী দুই-ই আছে—অসতী মেয়েমানুষ কখন চোখে দেখিনি—আমার বড় সাধ হয়, তারা কি রকম! ঠিক আমাদের মত, না আর কোন রকম! তারা কি করে, কি ভাবে, কি খায়, কেমন করে শুয়ে ঘুমায়—এ-সব আমার দেখতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, তুমি দেখেছ?

 নীলাম্বর বলিল, দেখেচি।

 দেখেচ? আচ্ছা, এই আমি যেমন করে বসে কথা কইচি তারা কি এমনি করে বসে যার-তার সঙ্গে কথা কয়?

 নীলাম্বর হাসিয়া বলিল, তা বলতে পারিনে—আমি তা দেখিনি।

বিরাজ ক্ষণকাল নিনিমেষ চোখে স্বামীর মুখপানে চাহিয়া রহিল। হঠাৎ কি

 বিরাজ—২