যদি কালো-কুচ্ছিত হতুম, তাহলে আমাকে কি ক’রে এত ভালবাসতে?
এই অদ্ভুত প্রশ্ন শুনিয়া যদিও সে কিছু বিস্মিত হইল, তথাপি একটা গুরুতর ভার তাহার বুকের উপর হইতে যেন সহসা গড়াইয়া পড়িয়া গেল।
সে খুশী হইয়া বলিল, ছেলেবেলা থেকে একটি পরমা সুন্দরীকেই ভালবেসে এসেছি—কি করে বলব এখন, সে কালো-কুচ্ছিত হলে কি করতুম?
বিরাজ দুই বাহ দ্বারা স্বামীর কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া আরও সন্নিকটে মুখ আনিয়া কহিল, আমি বলব? তা হলেও তুমি আমাকে এমনই ভালবাসতে।
তথাপি নীলাম্বর নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।
বিরাজ বলিল, তুমি ভাবচ, কি করে জানলুম?—না?
এবার নীলাম্বর আস্তে আস্তে বলিল, ঠিক তাই ভাবচি—কি করে জানলে।
বিরাজ গলা ছাড়িয়া দিয়া বুকের একধারে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িয়া উপর দিকে চাহিয়া চুপি চুপি বলিল, আমার মন বলে দেয়। আমি তোমাকে যত চিনি, তুমি নিজেও নিজেকে তত চেন না। তাই জানি, আমাকে তুমি এমনই ভালই বাসতে। যা অনায়, যাতে পাপ হয়, এমন কাজ তুমি কখন করতে পার না—স্ত্রীকে ভাল না বাসা অন্যায় তাই আমি জানি, যদি আমি কানা-খোঁড়াও হতুম, তবুও তোমার কাছে এমন আদরই পেতুম।
নীলাম্বর জবাব দিল না।
বিরাজ একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া সহসা হাত বাড়াইয়া আন্দাজ করিয়া চোখের কোণে আঙুল দিয়া বলিল, জল কেন?
নীলাম্বর তাহার হাতটি সযত্নে সরাইয়া দিয়া ভারী গলায় বলিল, জানলে কি করে?
বিরাজ বলিল, ভুলে যাও কেন যে আমার ন’বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। ভুলে যাও কেন যে তোমাকে পেয়ে তবে তোমাকে পেয়েচি। নিজের গায়ে হাত দিয়েও টের পাও না যে, আমিও ঐ সঙ্গে মিশে আছি?
নীলাম্বর কথা কহিল না। আবার তাহার নিমীলিত চোখের দুই কোণ বাহিয়া ফোঁটা জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।
বিরাজ উঠিয়া বসিয়া আঁচল দিয়া তাহা সযত্নে মুছাইয়া দিয়া গাঢ়ম্বরে বলিল, ভেব না, মরণকালে তোমার আমার হাতে পুঁটিকে দিয়ে গিয়েছেন, সেই পুঁটির ভাল হবে বলে যা ভাল বুঝেচ তাই করেচ—স্বর্গে থেকে মা আমাদের আশীর্বাদ করবেন। তুমি শুধু এখন সুস্থ হও, ঋণমুক্ত হও—যদি সর্বস্ব যায় তাও যাক।
নীলাম্বর চোখ মুছিতে মুছিতে রুদ্ধস্বরে কহিল, তুই জানিস নে বিরাজ, আমি কি করেচি—আমি তোর—
বিরাজ বলিতে দিল না। মুখে হাত চাপা দিয়া বলিয়া উঠিল, সব জানি আমি।