পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাজবৌ
৪৯

 মোহিনী কহিল, সে হবে না দিদি, সারারাত এই দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, সেও থাকব, কিন্তু আজকের দিনে তোমার আশীর্বাদ না নিয়ে যাব না।

 বিরাজ উঠিয়া কপাট খুলিরা সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল; দেখিল, মোহিনীর বাঁ হাতে এক চুপড়ি খাবার, ডান হাতে ঘটিতে সিদ্ধিগোলা। সে পায়ের কাছে নামাইরা রাখিয়া দুই পায়ের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, শুধু এই আশীর্বাদ কর দিদি, যেন তোমার মত হতে পারি—তোমার মুখ থেকে আমি আর কোন আশীর্বাদ পেতে চাইনে।

 বিরাজ সজল চক্ষু আঁচলে মুছিয়া নিঃশব্দে ছোটবধূর অবনত মস্তকে হাত রাখিল।

 ছোটবৌ দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, আজকের দিনে চোখের জল ফেলতে নেই, কিন্তু, সে কথা ত তোমাকে বলতে পারলুম না দিদি; তোমার দেহের বাতাসও যদি আমার দেহে লেগে থাকে, ত, সেই জোরে বলে যাচ্ছি, আসচে বছরে এমনই দিনে সে কথা বলব।

 মোহিনী চলিয়া গেলে বিরাজ সেইসব ঘরে তুলিয়া রাখিয়া স্থির হইয়া বসিল। মোহিনী যে অহর্নিশ তাহাকে চোখে চোখে রাখে, এ কথা আজ সে আরও স্পষ্ট করিয়া বুঝিল। তার পর কত ছেলে আসিল, গেল, বিরাজ আর ঘরে দোর দিল না, এই সব দিয়া আজিকার দিনের আচার পালন করিল।

 পরদিন সকালবেলা সে ক্লান্তভাবে দাওয়ায় বসিয়া শাক বাছিতেছিল, সুন্দরী আসিয়া প্রণাম করিল।

 বিরাজ আশীর্বাদ করিয়া বসিতে বলিল।

 সুন্দরী বসিয়াই বলিল, কাল রাত্তির হয়ে গেল, তাই আজ সকালেই বলতে এলুম। কিন্তু যাই বল বৌমা, এমন জানলে আমি কিছুতেই যেতুম না।

 বিরাজ বুঝিতে পারিল না—চাহিয়া রহিল।

 সুন্দরী বলিতে লাগিল, বাড়িতে কেউ নেই—সবাই গেছে পশ্চিমে হাওয়া খেতে। আছে এক বড়ো পিসী, তার শক্ত শক্ত কথা কি বৌমা, বলে, ফিরিয়ে নিয়ে যা। জামাইয়ের পর্যন্ত একখানা কাপড় পাঠায় নি, শুধু একখানা সুতোর কাপড় নিয়ে পুজোর তত্ত্ব কত্তে এসেচে! তারপর ছোটলোক, চামার, চোখের চামড়া নেই—এ যে কত বললে, তা আর বলে কি হবে।

 বিরাজ বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল, কে কাকে বললে রে?

 সুন্দরী বলিল, কেন, আমাদের বাবুকে।

 বিরাজ অধীর হইয়া উঠিল। সে কিছুই জানিত না, কিছুই বুঝিল না। কহিল, আমাদের বাবুকে কে বললে তাই বল্।

 এবার সুন্দরীও কিছু আশ্চর্য হইয়া বলিল, তাই ত-এতক্ষণ বলচি বৌমা!

 বিরাজ—৪