পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাজবৌ

পাথরখালির একধারে আসিয়া নীলাম্বর ছোটবোনটির হাত ধরিয়া বসি। নদীর উভয় তীরেই বড় বড় আমবাগান এবং বাঁশঝাড়, দুই-একটা বহু প্রাচীন অশ্বত্থ, বট নদীর উপর পর্যন্ত ঝুকিয়া পড়িয়া শাখা মেলিয়া দিয়াচে। ইহাদের শাখায় কতকাল কত পাখি নিরুদ্বেগে বাসা বাঁধিয়াছে, কত শাবক বড় করিয়াছে, কত ফল খাইয়াছে, কত গান গাহিয়াছে, তাহারই ছায়ায় বসিয়া ভাইবোন ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিল।

 হঠাৎ হরিমতি রাধার ক্রোড়ের কাছে আরও একটু সরিয়া আসিয়া বলিল, আচ্ছা দাদা, বৌদি কেন তোমাকে বোষ্টমঠাকুর বলে ডাকে?

 নীলার গলায় তুলসীর মালা দেখাইয়া হাসিয়া বলিল, আমি বোষ্টম বলেই ডাকে।

 হরিমতি অবিশ্বাস করিয়া বলিল, যাঃ—তুমি কেন বোষ্টম হবে? তারা ত ভিক্ষে করে! আচ্ছা, ভিক্ষে কেন করে দাদা?

 নেই বলেই করে!

 হরিমতি মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিছু নেই? তাদের পুকুর নেই, বাগান নেই, ধানের গোলা নেই—কিচ্ছুটি নেই?

 নীলাম্বর সস্নেহে হাত দিয়া বোনটির মাথার চুলগুলি নাড়িয়া দিয়া বলিল, কিচ্ছুটি নেই দিদি, কিচ্ছুটি নেই—বোষ্টম হলে কিচ্ছুটি থাকতে নেই।

 হরিমতি বলিল, তবে সবাই কেন তাদের কিছু কিছু দেয় না?

 নীলাম্বর বলিল, তোর দাদাই কি তাদের দিয়েছে রে?

 কেন দাও না দাদা, আমাদের ত এত আছে।

 নীলাম্বর সহাস্যে বলিল, তবুও তোর দাদা দিতে পারে না। কিন্তু তুই যখন রাজার বৌ হবি দিদি, তখন দিস।

 হরিমতি বালিকা হইলেও কথাটায় লজ্জা পাইল! দাদার বুকে মুখ লুকাইয়া বলিল, যাঃ—

 নীলাম্বর দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া তাহার মস্তক চুম্বন করিল। মা মরা এই ছোটবোনটিকে সে যে কত ভালবাসিত তাহার সীমা ছিল না। তিন বছরের শিশুকে বড়বৌ ব্যাটার হাতে সঁপিয়া দিয়া তাহাদের বিধবা জননী সাত বৎসর পূর্বে স্বর্গারোহণ করে। সেইদিন হইতে নীলাম্বর ইহাকে মানুষ করিয়াছে। সময় গ্রামের রোগীর সেবা করিয়াছে, মড়া পোড়াইয়াছে, কীর্তন গাহিয়াছে। গাঁজা খাইয়াছে; কিন্তু জননীর শেষ আদেশটুকু এক মুহূর্তের জন্য অবহেলা করে নাই। এমনি করিয়া বুকে করিয়া মানুষ করিয়াছিল বলিয়াই হরিমতি মায়ের মত অসঙ্কোচে দাদার বুকে মুখ রাখিয়া চুপ করিয়া রহিল।

 অদৃশ্যে পুরাতন ঝির গলা শোনা গেল—পুঁটি, বৌমা ডাকচেন, দুধ খাবে এস। হরিমতি মুখ তুলিয়া মিনতির স্বরে বলিল, দাদা, তুমি বলে দাও না, এখন দুধ