পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৯৮

 এমাম হাসানের পীড়িত অবস্থা দেখিয়া মায়মুনার চক্ষে জল আসিল। সকলেই বলিতে লাগিল, “আহা! কোলে-কাঁধে করিয়া মানুষ করিয়াছে, ও-আর কাঁদিবে না!”—মায়মুনার চক্ষের জল গণ্ড বাহিয়া পড়িতে লাগিল। মায়মুনা গৃহমধ্যস্থিত সকলের দিকেই এক একবার তাকাইয়া চক্ষের জল দেখাইল। মায়মুনা যে শুধু চক্ষের জলই সকলকে দেখাইতেছে, তাহা নহে; আরও উদ্দেশ্য আছে। ঘরের মধ্যে যেখানে যেখানে যে যে জিনিষপত্র রক্ষিত আছে, তাহা সকলই সে মনসংযোগ করিয়া জলপূর্ণ নয়নে বিশেষরূপে দেখিতেছিল।

 হাসানের জলপিপাসা হইয়াছে। তিনি সঙ্কেতে হাসনেবানুকে জলপানেচ্ছা জানাইলেন। তিনি মহাব্যস্তে “আব্‌খোরা” পরিষ্কার করিয়া সোরাহীর শীল ভগ্ন করিলেন, এবং সোরাহীর জলে আব্‌খোরা পূর্ণ করিয়া হাসানের সম্মুখে ধরিলেন। জলপানে তৃপ্তিলাভ করিয়া হাসান পুনরায় শয্যাশায়ী হইলেন। হাসানের আব্‌খোরা যথাস্থানে রাখিয়া, পূর্ব্ববৎ বস্ত্রের দ্বারা মুখবন্ধ ও শীলমোহর করিয়া হাসনেবানু সোরাহীটি যথাস্থানে রাখিয়া দিলেন।

 যে যাহাকে দেখিতে ইচ্ছা করে না, সে তাহার নামও শুনিতে ভালবাসে না। জগতে এমন অনেক লোক আছে যাহারা স্বভাবতই এক এক জনকে দেখিতে ভালবাসে না। অন্যপক্ষে—পরিচয় নাই, শত্রুতা নাই, মিত্রতা নাই, অলাপ নাই, বন্ধুত্ব নাই, স্বার্থ নাই,—কিছুই নাই, তথাপি যেন কাহারও মুখখানি দেখিতে ইচ্ছা করে। এমন মুখও জগতে অনেক আছে, পরিচয়ে পরিচিত হইলেও সেই মুখখানি যতবার দেখিতে পাওয়া যায়, ততবারই সুখবোধ হয়।

 হাসনেবানু জলের সোরাহী যথাস্থানে রাখিয়া ঈষৎ বিরক্তির সহিত মায়মুনার দিকে চাহিয়া চলিয়া গেলেন। রোগীর রোগশয্যার পার্শ্বে সকলেই নীরব। সকলের মুখাকৃতিই মলিন। মায়মুনার মুখ ফুটিল:—

 “আহা! এ নরাধম জাহান্নমী কে? আহা! এমন সোণার শরীরে কে এমন নির্দ্দয়রূপে আঘাত করিয়াছে? আহা! জান্নাতবাসিনী বিবি ফাতেমার হৃদয়ের ধন, নুরনবীর চক্ষের পুত্তলী যে হাসান, সেই হাসানের প্রতি এতদূর