পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৫
মহরম পর্ব্ব—ষোড়শ প্রবাহ

জাগরিত দেখিয়া তাঁহার শরীরের অবস্থা জিজ্ঞাসা করিবার অগ্রেই তিনি নিজেই হাসনেবানুকে স্বপ্ন বিবরণ বলিলেন, এবং “অত্যন্ত জলপিপাসা হইয়াছে এক পেয়ালা পানি দাও” বলিয়া উঠিয়া বসিলেন। স্বপ্নবিবরণ শুনিবামাত্রই হাসনেবানুর চিত্ত আরও অস্থির হইল; বিবেচনা-শক্তির লাঘব হইয়া গেল, মস্তক ঘুরিয়া পড়িল। সোরাহীর বস্ত্রের প্রতি পুর্ব্বে যেরূপ লক্ষ্য করিয়া দেখিতেন, তাহা আর দেখিবার তাঁহার ক্ষমতা থাকিল না। হাসনেবাসু স্বাভাবিক অবস্থায় থাকিলে বস্ত্রের উপরিস্থ হীরকচূর্ণ ঘর্ষণের কোন না কোন চিহ্ন অবশ্যই তাঁহার চক্ষে পড়িত, কিন্তু স্বপ্নবৃত্তান্ত শ্রবণে তিনি এমনি বিহ্বল হইয়াছেন যে, সোরাহীর মুখ বন্ধ না থাকিলেও তিনি নিঃসন্দেহে জল ঢালিয়া স্বামীকে পান করিতে দিতেন! এক্ষণে তিনি অন্যমনস্কে সোরাহী হইতে জল ঢালিয়া পেয়ালা পরিপূর্ণ করিয়া স্বামীর হস্তে প্রদান করিলেন। এমাম হাসানের এই শেষ পিপাসা;—হাসনেবানুর হস্তে এই শেষ জলপান। তিনি প্রাণ ভরিয়া জল পান করিলেন। জয়নাবও পূর্ব্ব আদেশমত জল লইয়া উপস্থিত হইলেন। হাসান হস্তপদাদি প্রক্ষালন করিয়া ঈশ্বরের উপাসনায় প্রবৃত্ত হইলেন; বসিয়া বসিয়া জীবনের শেষ-উপাসনা,—ইহজগতের শেষ আরাধনা আজ শেষ হইল; অন্তরও জ্বলিয়া উঠিল।

 কাতর হইয়া হাসান বলিতে লাগিলেন, “আজ আবার কি হইল! জাএদার ঘরে যে প্রকার শরীরে জ্বালা উপস্থিত হইয়া প্রাণ অস্থির করিয়াছিল, এ সেরূপ নয়! কালিজা, হৃদয় হইতে নাভি পর্য্যন্ত কি এক প্রকারের বেদনা, যাহা মুখে বলিতে শক্তি নাই! ঈশ্বর একি করিলেন! আবার বুঝি বিষ! এ-ত আর জাএদার ঘর নহে! তবে এ কি!—এ কি যন্ত্রণা! উঃ!— কি যন্ত্রণা!”

 বেদনায় হাসান অত্যন্ত কাতর হইলেন;—জাএদার ঘরে যেরূপ যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিলেন, তাহার চতুর্গুণ যন্ত্রণা ভোগ করিতে লাগিলেন। ব্যগ্রভাবে তিনি কাসেমকে কহিলেন, “শীঘ্র শীঘ্র হোসেনকে ডাকিয়া আন। আমি নিতান্তই অস্থির হইয়াছি। আমার হৃদয়, অন্তর, শরীর, —সমুদয় যেন অগ্নিসংযোগে জুলিতেছে, সহস্র সূচিকার দ্বারা যেন বিদ্ধ