পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১১০

হাসান চুপিচুপি বলিতে লাগিলেন, “জাএদা! তোমার চক্ষু হইতে হাসান এখন চিরদিনের জন্য দূর হইতেছে-আশীর্ব্বাদ করি, সুখে থাক। তুমি যে কার্য্য করিলে, সমস্তই আমি জানিতে পারিয়াছি। তোমাকে বড়ই বিশ্বাস করিতাম, বড়ই ভালবাসিতাম,—তাহার উপযুক্ত কার্য্যই তুমি করিয়াছি। ভাল! সুখে থাক, আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। হোসেনকেও ক্ষমা করিতে বলিয়াছি, তাহাও তুমি স্বকর্ণে শ্রবণ করিয়াছ। ভিতরের নিগূঢ় কথা যদি আমি হোসেনকে বলিতাম, তাহা হইলে যে কি অনর্থ সংঘটিত হইত, তাহা ত তুমি বুঝিতেই পারিতেছ। যাহা হউক আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম, কিন্তু যিনি সর্ব্বসাক্ষী, সর্ব্বময়, সর্ব্বক্ষমার অধীশ্বর, তিনি তোমাকে ক্ষমা করিবেন কি না বলিতে পারি না। তথাপি তোমার মুক্তির জন্য সর্ব্ব প্রযত্নে আমি সেই মুক্তিদাতার নিকট পুনঃপুনঃ প্রার্থনা করিব।—যে পর্যন্ত তোমাকে মুক্ত করাইতে না পারিব, সে পর্য্যন্ত আমি স্বর্গের সোপানে পা রাখিব না।”

 জাএদা অধোমুখে অশ্রু বিসর্জ্জন করিলেন। একটিও কথা কহিলেন না। সময়োচিত সঙ্কেতধ্বনি শ্রবণে হোসেনের সহিত আর আর সকলেই সেই গৃহমধ্যে পুনঃ প্রবেশ করিলেন। হাসান একে একে সকলের নিকট বিদায় লইলেন, হাসনেবাসু ও জয়নাবের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া নিজকৃত অপরাধের মার্জ্জনা চাহিলেন। শেষে হোসেনকে তিনি কহিলেন,“হোসেন এস ভাই। জন্মের মত তোমার সহিত আলিঙ্গন করি।”—এই বলিয়া অনুজের গলা ধরিয়া সাশ্রুনয়নে আবার বলিতে লাগিলেন, “ভাই, সময় হইয়াছে! মাতামহ স্বর্গের দ্বারে দাঁড়াইয়া ঐ ডাকিতেছেন! চলিলাম!” এই শেষ কথা করিয়াই ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে দয়াময় এমাম হাসান সর্ব্বসমক্ষে প্রাণত্যাগ করিলেন। যে দিন এমাম হাসান মর্ত্যলীলা সংবরণ করেন, সেইদিন হিজরী ৫০ সনের ১লা রবিয়ল আউওল তারিখ। হাস্‌নেবানু, জয়নাব, কাসেম ও আর আর সকলে হাসানের পদলুষ্ঠিত হইয়া মাথা ভাঙ্গিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। জাএদা কাঁদিয়াছিলেন কি না, তাহ কেহ লক্ষ্য করেন নাই।