পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১২০

ক্রমশঃই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। শয়নকক্ষে সুশীতল জলপূর্ণ স্বর্ণসোরাহী ছিল, এজিদ জল পান করিয়া পিপাসা নিবৃত্তি করিলেন। এবং শুকতারার উদয় দেখিয়া আর ঘুমাইলেন না, প্রাতঃক্রিয়াদি সমাপন করিয়া রাজপরিচ্ছদ ধারণ করিলেন। এদিকে জগৎ-লোচন রবিদেব সহস্র কর বিস্তার করিয়া আসিতেছেন,—কাহার সাধ্য, তাঁহার সম্মুখে দাড়ায়? শুকতারার অন্তর্দ্ধান, ঊষার আগমন ও প্রস্থান, দেখিতে দেখিতে সূর্য্যদেবের অধিষ্ঠান। এজিদের প্রকাশ্য দরবার দেখিবার আশায় যেন পূর্ব্বাকাশপতি লোহিত বর্ণ ধারণ করিয়া হাসিতে হাসিতে পূর্ব্বাকাশে দেখা দিলেন, দামেস্ক নগরীকে জাগরিত করিলেন। স্বামীহন্তা জাএদাকে এজিদ পুরস্কৃত করিবেন, সাহায্য-কারিণী মায়মুনাকে অর্থদান করিবেন, জাএদাকে মারওয়ানের স্বীকৃত স্বর্ণমুদ্রা দান করিয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিবেন, অধিকন্তু জাএদাকে পাটরাণীরূপে গ্রহণ করিবারও ইচ্ছা তাঁহার আছে! সূর্য্যদেব প্রতি ঘরে ঘরে স্বকীয় কিরণ-বিকীরণের সহিত ঐ কথাগুলি যেন ঘোষণা করিয়া দিলেন। রাজমুকুট শিরে ধারণ করিয়া মহারাজ এজিদ খাস্-দরবারে বার দিলেন। প্রহরিগণ সশস্ত্রে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দণ্ডায়মান হইল। অমাত্যগণ এবং পূর্ব্বাহূত নগরস্থ প্রধান প্রধান মাননীয় মহোদয়গণ স্ব স্ব স্থান পূর্ণ করিয়া দরবারের শোভা সংবর্ধন করিলেন। মায়মুনা ও জাএদা পূর্ব আদেশ-অনুসারে পূর্ব্বেই দরবারে নীত হইয়াছিলেন। শাহী তক্তের বাম পার্শ্বে দুইটি স্ত্রীলোক। জাএদা রজতাসনে আসীনা, মায়মুনা কাষ্ঠাসনে উপবিষ্টা,—জাএদার প্রতি অনেকেরই দৃষ্টি পড়িয়াছে। যাঁহারা জাএদার কৃত কার্য্য বিষয়ে সবিশেষ পরিজ্ঞাত, অথচ এমাম হাসানের প্রিয়পাত্র ছিলেন, তাঁহারা জাএদার সাহসকে ধন্যবাদ দিয়া তাঁহার ঘর্ম্মাক্ত ললাট, বিস্ফারিত লোচন ও আয়ত ভ্রূযুগলের প্রতি ঘন ঘন সস্পৃহ দৃষ্টিপাত করিতেছেন।

 এজিদ বলিতে লাগিলেন, “আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, হাসান আমার চিরশত্রু ছিল, সে নানা প্রকারে আমায় কষ্ট দিয়াছে। আমি কৌশল করিয়া এই সিংহাসন রক্ষা করিয়াছি; সেই চিরশত্রু হাসান কোন বিষয়েই আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল না; তথাপি তাহার বংশগৌরব এত প্রবল ছিল যে, নানা প্রকার অযথা কটুক্তির দ্বারা সর্ব্বদাই আমার মনে সে ব্যথা দিয়াছে।