পূর্বস্বামী হইতে পরিত্যক্ত হইয়া সে যেমন অনাথিনী হইয়াছিল, আপনাকে স্বামীত্বে বরণ না করিয়া আজিও সেই জয়নাব সেইরূপ পথের কাঙ্গালিনী ও পথের ভিখারিণী। বাদশাহ্-নামদার! জগৎ কয়দিনের? সুখ কয় মুহূর্ত্তের? একবার ভাবিয়া দেখুন দেখি,—নিরপেক্ষভাবে একবার ভাবিয়া দেখুন দেখি, হাসান কি আপনার শত্রু? হাসান আপনার রাজ্য আক্রমণ করে নাই, আপনার প্রাণবধে অগ্রসর হয় নাই, জয়নাবকে কৌশলেও হস্তগত করে নাই,—এ সকলই আপনি বিদিত আছেন। হইতে পারে, একটি ভালবাসার জিনিষের দুইটি গ্রাহক হইলে পরস্পরের অন্তরে জাতক্রোধ আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহা আমি স্বীকার করি। কিন্তু সে ঘটনায় হাসানের অপরাধ কি? সে মীমাংসা স্বয়ং জয়নাবই ত করিয়াছে। তাহার শাস্তিও হইল। অধিক হইয়াছে। এক্ষণে হোসেনের প্রাণবধ করা, কি হাসানের পুত্রের প্রাণ হরণ করা মানুষের কার্য্য নহে। বলুন ত, কি অপরাধে তাঁহাদিগকে বিনাশ করিবেন? এখনও পর্য্যন্ত হোসেনের ভ্রাতৃবিয়োগ-শোক অণুমাত্রও হ্রাস হয় নাই। পিতৃহীন হইলে যে কি মহাকষ্ট, তাহা জগতে কাহারও অবিদিত নাই। কাসেম এত অল্প সময়ে কি তাহা ভুলিয়াছে? আজও পর্য্যন্ত হাসনেবানুর উদরে অন্ন নাই, চক্ষের জল নিবারণ হয় নাই, তাঁহার অঙ্গ ধূলায় ধূসরিত হইতেছে! জয়নাবের কথা আর বলিলাম না! মদিনার আবালবৃদ্ধ, এমন কি পশুপক্ষীরাও ‘হায় হাসান’! ‘হায় হাসান!’ করিয়া কাঁদিতেছে। বোধ হয় বক্ষে করাঘাতে কাহারও কাহারও বক্ষ ফাটিয়া শোণিতের ধারা বহিতেছে! তথাপি ‘হায় হাসান’! ‘হায় হাসান!!’ রবে জগৎ কাঁপাইতেছে। যে শুনিতেছে, সেই-ই মুখে বলিতেছে, ‘হায় হাসান!’ ‘হায় হাসান!!’ এ অবস্থায় কি আর যুদ্ধসজ্জায় অগ্রসর হইতে আছে? এই ঘটনায় কি আর ভ্রাতৃবিয়োগীর প্রতি তরবারি ধরিতে আছে? এই দুঃখের সময় কি অনাথা পতিহীনা স্ত্রীগণের প্রতি কোন অত্যাচার করিতে আছে? হায়! হায়!! সেই পিতৃহীন, পিতৃব্যহীন বালকদিগের মুখের প্রতি চাহিয়া কি কেহ কাঁদিবে না? এখন তাহারা শোকে দুঃখে আচ্ছন্ন, অসীম কাতর; এ সময় আর যুদ্ধের প্রয়োজন নাই। শত্রু-পরিবার
পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্রফ হোসেন.pdf/১৪৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৭
মহরম পর্ব্ব—ঊনবিংশ প্রবাহ