পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১৭০

করিবে। তাহা হইলে হইল কি? তুমিই বালক দুইটির বধের উপস্থিত কারণ হইলে। তৎপরিবর্ত্তে কতকগুলি মোহর পাইবে সত্য—আচ্ছা বল ত, সে মোহর তোমার কত দিন থাকিবে? এখন যে অবস্থায় আছ, দয়াময় দাতা অনুগ্রহকারী ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হও। তোমার সমশ্রেণীর লোক কত স্থানে কত প্রকার কষ্টভোগ করিতেছে। তোমার অপেক্ষা কত উচ্চ শ্রেণীর লোক তোমার হইতেও মন্দ অবস্থায় দিন কাটাইতেছে। তুমি সকল বিষয়ে নিশ্চিন্ত—মহাসুখী। ইহার উপরেও তোমার লোভের অন্ত নাই। বিচারকর্ত্তা অদ্বিতীয় এলাহীর প্রতিও তোমার ভক্তি নাই, ভয়ও নাই। তিনি সর্ব্বদর্শী, তাহাও যেন তোমার মনে নাই। হায় হায়! তোমার মত পাষাণ প্রাণ পাথরের দেহ ত আমি কাহারও দেখি নাই। পিতৃহীন নিরপরাধ বালকদ্বয়ের দেহরক্তের মূল্যই নরপতি জেয়াদের চক্ষে পাঁচ হাজার মোহর! হইতে পারে—তাঁহার চক্ষে অন্য রূপ! হউক্ পাঁচ হাজার মোহর! তুমি সে রক্তমাখা মোহরের জন্য এত লালায়িত কেন? তুমি কি বোঝ নাই যে, ঐ দুই বালকের শরীরের রক্তের মূল্য পাঁচ হাজার মোহর? তুমি রক্তমাখা মোহরলোভে বালক দুইটির অমূল্য জীবনের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া নিজের বিষময় অস্থায়ী সুখের প্রতি দৃষ্টি করিতেছ! আর এক কথা, সেও দিবে, আর তুমিও পাইবে! পাঁচ হাজার মোহরই তোমার লক্ষ্য, অন্তরেও এই কথাই জাগিতেছে—‘বালক দুইটিকে যদি ধরিতে পারি, পাঁচটি হাজার খাঁটী সোণার মোহর! হা অদৃষ্ট!—আমার কপালে কি তাহা আছে?’ মনে মনে এই ভাবের কথাই ত ভাবিতেছ? বার বার সেই নররক্তমাখা কদর্য্য মোহরগুলির প্রতিই অন্তর-চক্ষুতেই কল্পনায় সাজান দেখিতেছ? মোহরের জন্য প্রকাশ্যে আক্ষেপও করিতেছ! বালক দুইটির জীবনের মূল্য হইতে মোহরের মুল্যই অধিক স্থির করিয়াছ! জানিলাম, তোমার মনে দয়ামায়ার একটি পরমাণুও নাই; এক ফেঁটা রক্তও নাই। তোমার হৃদয়ে সাধারণ রক্তও নাই,—পাথর চোয়াইয়া রস ঝরিতে পারে? তোমার হৃদয় পাষাণ, দেহটা পোড়া মাটির, অস্থিমজ্জাসমুদয় কঙ্করে পূর্ণ। ইহাতে আর আশা কি?”