পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১৭২

আমি তোমার নিকট রতি-পরিমাণ সোণাও চাহি না এবং ও-রক্তমাখা মোহরের জন্য লালায়িত নই। পিতৃহীন বালকদ্বয়ের শোণিতরঞ্জিত মোহর চক্ষেও দেখিতে ইচ্ছা করি না। ছুঁইতেও পারিব না! জীবন কয় দিনের? ঈশ্বরের নিকট কি উত্তর দিবে? আমি তোমার দুইখানি হাত ধরিয়া অনুরোধ করিতেছি, আমার মাথার দিব্বি দিয়া বলিতেছি, তুমি লোভের বশীভূত হইয়া এমন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইও না।”

 হারেস্ স্ত্রীরত্নের কথায় ক্রোধে আগুন হইয়া রক্তলোচনে আঁখি ঘুরাইয়া বলিলেন,—“চুপ! চুপ! নারীজাতির মুখে ধর্ম্মকথা আমি শুনি না। এখন খাইবার কি আছে, শীঘ্র শীঘ্র আন। একটু বিশ্রাম করিয়া এই রাত্রেই আবার সন্ধানে বাহির হইব। দেখি কপালে কি আছে! তোর ও-মিছরীমাখা কথা আমি শুনিতে ইচ্ছা করি না।”

 হারেসের স্ত্রী আর কোন কথা কহিলেন না। স্বামীর আহারের আয়োজন করিয়া দিলেন। হারেস মনে মনে নানা চিন্তা করিতে করিতে অন্যমনস্ক আহার করিলেন এবং হস্ত মুখ প্রক্ষালন করিয়া তখনি শয়ন করিলেন। এত পরিশ্রমেও তাঁহার চক্ষে নিদ্রা নাই। কোথায় ছেলে দুইটিকে পাইবেন, কোন্ পথে, কোথায় কোন্ স্থানে গেলে তাহাদের দেখা পাইবেন, দেখা পাইয়া কি প্রকারে ধরিয়া রাজদরবারে লইয়া যাইবেন, এইসকল চিন্তাই তাহার মাথার মধ্যে ঘুরিতে লাগিল। বালক দুইটির দেখা পাওয়া—পাঁচ হাজার সোণার টাকা, এই সকল ভাবিতে ভাবিতে বহুক্ষণ পরে তিনি ঘুমাইয়া পড়িলেন।

 গৃহিণী দেখিলেন,— স্বামী ঘোর নিদ্রায় অচেতন। কি উপায়ে ছেলে দুইটিকে রক্ষা করিবেন, এই চিন্তা করিয়া পরামর্শে বসিলেন। এ পর্য্যন্ত তিনি ও পরিচারিকা ভিন্ন বাড়ীর অন্য কেহও বালকদ্বয়ের কথা জানেন নাই। এখন বাধ্য হইয়া স্বামীর ঐরূপ ভাব দেখিয়া, তাঁহার মুখের কথা শুনিয়া দয়াবতী স্নেহময়ী রমণী অস্থির হইয়াছেন। কি উপায়ে পিতৃহীন বালকদ্বয়কে রক্ষা করিবেন? স্বামীর অদ্যকার মনের ভাবে—ভয়ের কারণই অধিক, আর আশ্রয়ের স্থানই বা কোথা? সত্য প্রকাশ পাইলে ছেলে দুইটির মাথা যায়! এমন কি, নিজের প্রাণের আশাও অতি সঙ্কীর্ণ! স্বামী পুরস্কার-লোভে