পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১৭৬

ভাই, এস! গলাগলি করিয়া একবার শয়ন করি।” দুই ভাই এই বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিতেই পাপমতি হারেসের নিদ্রাভঙ্গ হইল। অতি ত্রস্তে শয্যাত্যাগ করিয়া তিনি স্ত্রীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার বাড়ীতে বালকের ক্রন্দন! কাহার ক্রন্দন? কোথায় তাহারা? কোথা হইতে তাহারা আসিয়াছে? কে তাহাদিগকে তোমার নিকটে আনিয়া দিল? শীঘ্র শীঘ্র প্রদীপ জ্বালিয়া আন; আর যাহারা কাঁদিতেছে, তাহাদিগকেও আমার সম্মুখে শীঘ্র শীঘ্র লইয়া আইস।”

 হারেস্-জায়া নীরব। কারণ, দুর্দ্দান্ত স্বামীর নিদ্রাভঙ্গ—প্রদীপ জ্বালিতে আদেশ, “যাহারা কাঁদিতেছে, তাহাদিগকে আমার সম্মুখে লইয়া আইস”—এই সকল কথায় সতী-সাধ্বী দয়াবতীর প্রাণপাখী যেন দেহ-পিঞ্জর হইতে ‘উড়ু উড়ূ’ করিতে লাগিল। কি করিবেন, কোথায় যাইবেন, কিছুই বোধ নাই—জ্ঞান নাই —তিনি নীরব রহিলেন। হারেস গৃহিণীর এইরূপ ভাব দেখিয়া অবাক হইলেন, মনে মনে বলিলেন: এ কি? হঠাৎ এরূপ হইল কেন? তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তোমার এ কি ভাব হইল?” কোন উত্তর নাই। গৃহিণী নির্ব্বাকে, এক ধ্যানে স্বামীর মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। হারেস স্ত্রীর এইরূপ অন্যমনস্ক ভাব দেখিয়া নিজেই প্রদীপ জ্বালিয়া যে গৃহ হইতে ক্রন্দন-শব্দ বাহির হইতেছিল, সন্ধান করিয়া প্রদীপহস্তে সেই গৃহে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, —দুইটি বালক গলাগলি করিয়া শুইয়া কাঁদিতেছে। তিনি দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন; অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “এ কাহারা? আমার বাড়ীর নির্জ্জন স্থানে পরম রূপবান্ দুইটি বালক শয়নাবস্থায় কাঁদে কেন?” তখন তিনি কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তোরা কে? কাঁদিস্ কেন? শীঘ্র বল্, কে তোরা?”

 বালকদ্বয় সভয়ে উত্তর করিলেন, “আমরা হজরত মোস্‌লেমের পুত্র।” হারেস নিকটে যাইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিতে লাগিলেন, “মোস্‌লেমের পুত্র! তোমরাই মোস্‌লেমের পুত্র! আমি কি আহম্মক—কি পাগল! ঘরে শিকার রাখিয়া জঙ্গলে ঘুরিতেছি! কি পাগলামী। যাক্, যাহা হইবার হইয়াছে। আমার অদৃষ্টজোরেই শিকার ঘরে আসিয়াছে! পাঁচ হাজার মোহর পায়ে হাঁটিয়া আমার নির্জ্জন ঘরে আসিয়া ঢুকিয়াছে। এখন কি করি?