পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহরম পর্ব্ব—প্রথম প্রবাহ

আমার নিকট ব্যক্ত কর। অর্থে হউক বা সামর্থ্যে হউক, বুদ্ধিকৌশলে হউক, যে কোন প্রকারেই হউক, তােমার মনের আশা আমি পূর্ণ করিবই করিব। তুমি আমার যত্নের রত্ন, অদ্বিতীয় স্নেহধার। তুমি পাগলের ন্যায় হতবুদ্ধি, অবিবেকের ন্যায় সংসারবর্জ্জিত হইয়া পিতামাতাকে অসীম দুংখসাগরে ভাসাইবে, বনে বনে পর্ব্বতে পর্ব্বতে, বেড়াইয়া বেড়াইয়া অমূল্য জীবনকে তুচ্ছজ্ঞানে হয়ত কোন দিন আত্মঘাতী হইয়া এই কিশাের বয়সে মৃত্তিকাশায়ী হইবে, ইহা ভাবিয়া আমার প্রাণ নিত্যই আকুল হইতেছে; কিছুতেই স্থির হইতে পারিতেছি না। জীবন যেন দেহ ছাড়িয়া যাই যাই করিতেছে, প্রাণপাখী যেন দেহ-পিঞ্জর ছাড়িয়া উড়ি উড়ি করিতেছে। বল দেখি, বৎস! কোন্ প্রাণে মাবিয়া তােমার মৃতদেহে শেষ বসন (কাফন) পরাইয়া মৃত্তিকায় প্রােথিত করিবে?”

 এজিদ্ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “পিতঃ! আমার দুঃখ অনন্ত। দুঃখের সীমা নাই, উপশমের উপায় নাই। আমি নিরুপায় হইয়াই জগতের আশা হইতে একেবারে বহুদূরে দাঁড়াইয়া আছি। আমার বিষয়-বিভব, ধনজন, ক্ষমতা, সমস্তই অতুল তাহা আমি জানি। আমি অবােধ নই; কিন্তু আমার অন্তর যে মােহিনী মূর্ত্তির সুতীক্ষ্ম নয়ন-বাণে বিদ্ধ হইতেছে, সে বেদনার উপশম নাই। পিতঃ! সে বেদনার প্রতিকারের উপায় নাই। যদি থাকিত, তবে বলিতাম। আর বলিতে পারি না। এতদিন অতি গােপনে মনে মনে রাখিয়াছিলাম, আজ আপনার আজ্ঞা শিরােধার্য্য করিয়া মনের কথা যতদূর সাধ্য বলিলাম। আর বলিবার সাধ্য নাই। হয় দেখিবেন, না হয় শুনিবেন,—এজিদ্ বিষপান করিয়া যেখানে শােকতাপের নাম নাই, প্রণয়ে হতাশা নাই, অভাব নাই এবং আশা নাই, এমন কোন নির্জ্জন স্থানে এই পাপময় দেহ রাখিয়া সেই পবিত্রধামে চলিয়া গিয়াছে। আর অধিক বলিতে পারিতেছি না, ক্ষমা করিবেন।” এই কথা শেষ হইতে না হইতেই বৃদ্ধা মহিষী একগাছি সুবর্ণ যষ্ঠি-আশ্রয়ে ঐ নির্জ্জন গৃহমধ্যে আসিয়া একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হইলেন। এজিদ্ শশব্যস্তে উঠিয়া জননীর পদচুম্বন করিয়া পিতার পদধুলি গ্রহণান্তর সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।