পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৯
মহরম পর্ব্ব—চতুর্বিংশ প্রবাহ

বাকা অলঙ্ঘনীয়; পথ ভুলিয়া আমরা কারবালায় আসিয়াছি, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। তোমরা কি কর্ণে কিছু শুনিতেছ?” তখন সকলেই মনোনিবেশ করিয়া শুনিতে লাগিলেন—চতুর্দ্দিকেই “হায়! হায়!!” রব। ধণ্ঠ নূরনবী মোহাম্মদ! হোসেন বলিলেন, “মাতামহ ইহাও বলিয়া গিয়াছেন, চতুর্দ্দিক হইতে যে স্থানে “হায়! হায়!!” শব্দ উত্থিত হইবে, নিশ্চয় জানিও সেই-ই কারবালা। ঈশ্বরের লীলা কাহারও বুঝিবার সাধা নাই। কোথায় যাইব? যাইবারই বা সাধ্য কি? কোথায় দামেস্ক, কোথায় মদিনা, কোথায় কুফা, আর কোথায় কারবালা! আমি কারবালায় আসিয়াছি, আর উপায় কি? ভাই সকল! ঈশ্বরের নাম করিয়া ক্ষান্ত দাও।” ক্রমে সঙ্গীরা সকলেই আসিয়া একত্রিত হইল। হোসেনের মুখে কারবালার বৃত্তান্ত এবং চতুর্দ্দিকে “হায়! হায়!” রব স্বকর্ণে শুনিয়া সকলেই মুখে কালিমা রেখা পড়িয়া গেল। সে যেখান হইতে শুনিল, সে সেইখানেই অমনি নীরবে বসিয়া পড়িল।

 হোসেন বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! আর চিন্তা কি? ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্য্যে ভাবনা কি? এই স্থানে শিবির নির্ম্মাণ করিয়া ঈশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহারই নাম ভরসা করিয়া থাকিব। সম্মুখে প্রান্তর, পার্শ্বে ভয়ানক বিজন বন, কোথায় যাই? অদৃষ্টে যাহা লেখা আছে, তাহাই ঘটিবে, এক্ষণে চিন্তা বিফল। শিবির নির্ম্মাণের আয়োজন কর। আমি জানি, ফোরাত নদী এই স্থানের নিকট প্রবাহিত হইতেছে। কতদূর এবং কোন্ দিকে তাহা নির্ণয় করিয়া কেহ কেহ জল আহরণে প্রবৃত্ত হও! পিপাসায় অনেকেই কাতর হইয়াছে, আহারাদি সংগ্রহ করিয়া আপাততঃ ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ কর।”

 শিবির নির্ম্মাণ করিবার কাষ্ঠ স্তম্ভ সংগ্রহ করিতে এবং রন্ধনপযোগী কাষ্ঠ আহরণ করিতে যাহারা বনমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, শোণিতাক্ত কুঠার-হস্তে অত্যন্ত বিষাদিত চিত্তে বাষ্পকুললোচনে তাহারা হোসেনের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিতে লাগিল, “হজরত! এমন অদ্ভুত ব্যাপার আমরা কোন স্থানে দেখি নাই, কোন দিন কাহারও মুখে শুনিও নাই।