পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯১
মহরম পর্ব্ব—চতুর্বিংশ প্রবাহ

বিতাড়িত করিয়া দিয়া বলিল, “মহারাজ এজিদের আজ্ঞায় ফোরাত নদীকূল রক্ষিত হইতেছে, এই রক্ষক বীরগণের একটি প্রাণ, যাঁচিয়া থাকিতে এক বিন্দু জল কেহ লইতে পারিবে না। আমাদের মস্তকের শোণিত ভূতলে প্রবাহিত না হইলে ফোরাত প্রবাহে কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে দিব না। জল লইয়া পিপাসা নিবৃত্তি করা ত অনেক দূরের কথা! এবার ফোরাতকূল চক্ষে দেখিয়াই ইহজীবন সার্থক করিয়া গেলে,—যাও; ভবিষ্যতে এদিকে আসিলে আমাদের দৃষ্টির সীমা পর্য্যন্ত থাকিতে হইবে। নদীতীরে এক পদও অগ্রসর হইতে দিব না। এবং সুতীক্ষ্ণ শরই তোমাদের পিপাসার শান্তি করিবে। প্রাণ বাঁচাইয়া ফিরিয়া যাও! নিশ্চয় জানিও, ফোরাতের সুস্নিগ্ধ বারি তোমাদের কাহারও ভাগ্যে নাই।”

 কথা শুনিয়া হোসেন মহাব্যস্ত হইলেন। খাদ্যাদির অভাব না থাকিলেও জলবিহনে কিরূপে বাঁচিবেন, এই চিন্তাই তাঁহার প্রবল হইল। মদিনার বহুসংখ্যক লোক সঙ্গে রহিয়াছে। অল্পবয়স্ক বালক-বালিকাগণ যখন পিপাসায় কাতর হইবে, যখন তাহাদের জিহ্বকণ্ঠ শুষ্ক হইয়া অর্দ্ধোচ্চারিত কথা বলিতেও ক্ষমতা থাকিবে না, তখন কি করিবেন? এই চিন্তায় হোসেন ফোরাত নদীর দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া কি উপায়ে জল সংগ্রহ করিবেন ভাবিতেছেন—এমন সময় দেখিতে পাইলেন যে, চারি জন সৈনিক পুরুষ তাঁহার শিবির লক্ষ্য করিয়া সম্ভবতঃ কিছু ত্রস্তে চলিয়া আসিতেছে। তিনি মনে মনে ভাবিলেন, ‘মোস্‌লেম আমার কুফা গমনে বিলম্ব দেখিয়া হয়তো সৈনিকগণকে কোন স্থানে রাখিয়া অগ্রে আমার সন্ধান লইতে আসিতেছে!’

 আগন্তুক চতুষ্টয় যতই নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল, ততই তাঁহার কল্পনা যে ভ্রমসঙ্কুল তাহা প্রমাণিত হইল। শেষে তিনি দেখিলেন যে, তাহারা অপরিচিত; এমন কি, কোন স্থানে তাহাদিগকে দেখিয়াছেন কি না, তাহাও মনে হইল না। সৈন্যচতুষ্টয় নিকটে আসিয়াই হোসেনের পদচুম্বন করিল। তন্মধ্য হইতে অপেক্ষাকৃত সজ্জিত পুরুষ কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া নতশিরে বলিতে লাগিলেন, “হজরত, দুঃখের কথা কি বলিব,