পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১৯৪

 শাহেরেবানু বলিলেন, “এই শিশুসন্তানটির জীবন রক্ষার্থে যদি আপনি নিজে গিয়াও কিঞ্চিৎ জল উহাকে পান করাইতে পারেন, তাহাতেই বা ক্ষতি কি? একটি প্রাণ ত রক্ষা হইবে? আমাদের জন্য আপনাকে যাইতে বলিতেছি না।”

 হোসেন বলিলেন, “জীবনে কোনও দিন শত্রুর নিকট, কি বিধর্ম্মীর নিকট কোন বিষয়েই প্রার্থী হই নাই। কাফেরের নিকট কোন কালে কিছু প্রার্থনাও করি নাই। জল চাহিলে কিছুতেই পাইব না। আর আমি এই শিশুর প্রাণ রক্ষার কারণেই যদি তাহাদের নিকট জল ভিক্ষা করি, তবে আমি চাহিলে তাহারা জল দিবে কেন? আমাকে মনোকষ্ট, মনোবেদনা দিতেই ত তাহারা ফোরাতকূল আবদ্ধ করিয়াছে?”

 শাহ্‌রেবানু বলিলেন, “তাহা যাহাই বলুন, আমরা বাঁচিয়া থাকিতে কি বলিয়া এই দুগ্ধপোষ্য সন্তান দুগ্ধ পিপাসায়,—শেষে জল পিপাসায় প্রাণ হারাইবে, ইহা কিরূপেই বা স্বচক্ষে দেখিব?”

 হোসেন আর দ্বিরুক্তি করিলেন না। সত্বর উঠিয়া গিয়া অশ্ব সজ্জিত করিয়া আনিয়া বলিলেন, “দাও, আমার ক্রোড়ে দাও! দেখি, আমার সাধ্যানুসারে যত্ন করিয়া দেখি।”—এই বলিয়া হোসেন অশ্বে উঠিলেন। শাহ্‌রেবানু সন্তানটি হস্তে লইয়া অশ্বপৃষ্ঠে স্বামীর ক্রোড়ে বসাইয়া দিলেন। হোসেন পুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া অশ্বে কশাঘাত করিলেন। মুহূর্ত্তমধ্যে তিনি ফোরাত নদীতীরে উপস্থিত হইয়া নদীতীরস্থ সৈন্যগণকে বলিলেন, “ভাই সকল, তোমাদের মধ্যে যদি কেহ মুসলমান থাক, তবে এই দুগ্ধপোশ্য শিশুর মুখের দিকে চাহিয়া কিঞ্চিৎ জলদান কর। পিপাসায় ইহার কণ্ঠতালু শুকাইয়া একেবারে নীরস কাষ্ঠের ন্যায় হইয়াছে। এ সময় কিঞ্চিৎ জলপান করাইতে পারিলেও বোধ হয় এ বাঁচিতে পারে! তোমাদের ঈশ্বরের দোহাই, এই শিশু সন্তানটির জীবন রক্ষার্থ ইহার মুখের প্রতি চাহিয়া কিছু জলদান কর। এই দুগ্ধপোষ্য শিশুর প্রাণরক্ষা করিলে পরমেশ্বর তোমাদের প্রতি প্রসন্ন হইবেন।”

 কেহই উত্তর করিল না। সকলেই একদৃষ্টে হোসেনের দিকে চাহিয়া