পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০১
মহরম পর্ব্ব—চতুর্বিংশ প্রবাহ

তোমাকে জীবিত ফিরিয়া আসিবার জন্য যুদ্ধে পাঠাই নাই। হয় ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া হোসেনের পুত্র-পরিজনকে রক্ষা করিতে দেখিব, না হয় রণক্ষেত্র-প্রত্যাগত তোমার মস্তকশূন্য দেহ দেখিয়া এই বৃদ্ধ বয়সে জীবন শীতল কবি, এই আমার আশা ছিল। তুমি বীরকূল-কলঙ্ক, আমার আশা ফলবতী হইতে দিলে না।”

 সভয়ে কম্পিত হইয়া আবদুল ওহাব কহিলেন, “জননি! আবার আমি যাইতেছি, আর ফিরিব না—হয় নদীকূল উদ্ধার, নয় আবদুল ওহাবের মস্তক দান। কিন্তু জননি! পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। পিপাসা নিবারণ করিবার আর উপায় নাই। একটিমাত্র নিবেদন, তোমার চরণদর্শনেই পিপাসার শান্তি! আর-একবার আমার স্ত্রীর মুখখানি—”

 হাঁ, বুঝিয়াছি। সেই মুখখানি দেখিতে পার, কিন্তু অশ্ব হইতে নামিতে পারিবে না।” মাতার অজ্ঞানুযায়ী সেই অবস্থাতেই আবদুল ওহাব আপন স্ত্রীর নিকট যাইয়া বলিলেন, “জীবিতেশ্বরি! আমি যুদ্ধযাত্রী। যুদ্ধ করিতে করিতে তোমার কথা মনে পড়িল, পিপাসাতেও প্রাণ আকুল। ভাবিলাম, তোমাকে দেখিলে বোধ হয়,—কিছু শ্রান্তি দূর হইবে, পিপাসা নিবারণ হইবে। এই মনে করিয়াই আসিয়াছি, কিন্তু অশ্ব হইতে নামিবার আদেশ নাই। মাতার আজ্ঞা, তাই—অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়াই সাক্ষাৎ করিলাম।”

 পতিপরায়ণা পতিব্রতা সতী পতির নিকটে যাইয়া অশ্ববঙ্গ ধারণপূর্ব্বক মিনতিবচনে কহিতে লাগিলেন, “জীবিতেশ্বর! সমরাঙ্গণে অঙ্গনার কথা মনে করিতে নাই। যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তঃপুরের কথা যাহার মনে পড়ে, সে আবার কেমন বীর? শত্রুকে পৃষ্ঠ দেখাইয়া যে যোদ্ধা স্ত্রীর মুখ দেখিতে আসে, সেই বা কেমন বীর প্রাণেশ্বর? আমি নারী, আমি ত ইহার মর্ম্ম কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। প্রভু মোহাম্মদের বংশধরগণের বিপদ-সময়ে সাহায্য করিতে স্ত্রী-পরিবার, সন্তানসন্ততির কথা যে যোদ্ধা মনে করে, তাহাকে আমি বীরপুরুষ রলি না। যদি আপনারা ভয় করেন, তবে আমরাই—এই ক্ষুৎ-পিপাসাপীড়িত স্ত্রীলোকেরাই, এলোচুলে রণরঙ্গিণী হইয়া রণবেশে সমরাঙ্গণে অসিহস্তে নৃত্য করিব; রণরঞ্জিত বস্ত্রে আমরাও রণসাজে সজ্জিত হইতে কুণ্ঠিত হইব না। দেখি,