পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২১৪

 বক্তার কথা মুখে থাকিতে থাকিতে, কাসেমের বর্শা প্রতিযোদ্ধার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া পৃষ্ঠ পার হইল। বর্জ্জকের পুত্রের শোণিতাক্ত শরীর অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে পড়িয়া গেল। তাহার কটিবন্ধের মহামূল্য অসি সজোরে আকর্ষণ করিয়া কাসেম বলিলেন, “কাফের! মূল্যবান্ অস্ত্রের ব্যবহার দেখ।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই বর্জ্জক-পুত্রের মস্তক যুদ্ধক্ষেত্রে ধূলিলুণ্ঠিত হইল। কাসেম বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্ম্মী কাফেরগণ! আর কাহাকে রণক্ষেত্রে কাসেমের সম্মুখে পাঠাইবি, পাঠা?”

 পাঠাইবার বেশী বিলম্ব হইল না। দেখিতে দেখিতে মহাবীর কাসেম বর্জ্জকের অপর তিন পুত্রকে শীঘ্র শীঘ্র শমনসদনে পাঠাইলেন। এইবার পুত্রশোকাতুর বর্জ্জক সেনাপতির আদেশের অপেক্ষা না করিয়া ভীমগর্জ্জনে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা দিলেন। বীরদর্পে তিনি বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তুমি ধন্য! ক্ষণকাল অপেক্ষা কর। তুমি আমার চারিটি পুত্র নিধন করিয়াছ, তাহাতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নাই। কাসেম! তুমি বালক। এত যুদ্ধ করিয়া অবশ্যই ক্লান্ত হইয়াছ। সপ্তাহকাল তোমার উদরে অন্ন নাই, কণ্ঠে জলবিন্দু নাই, এ অবস্থায় তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করা কেবল বিড়ম্বনা মাত্র।”

 কাসেম বলিলেন, “বর্জ্জক! সে ভাবনা তোমায় ভাবিতে হইবে না। তুমি পুত্রশোকে যে প্রকার বিহ্বল হইয়াছ দেখিতেছি, তাহাতে তোমার পক্ষে এ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়াই বিড়ম্বনা।”

 বর্জ্জক বলিলেন, “কাসেম আমি তোমার কথা স্বীকার করি, পুত্রশোকে অতি কঠিন হৃদয়ও বিহ্বল হয়, কিন্তু পুত্রহন্তার মস্তক লাভের আশা থাকিলে—এখনই পুত্রমস্তকের পরিশোধ হইবে নিশ্চয় জানিতে পারিলে, বীরহৃদয়ের বিহ্বলতাই বা কি? দুঃখই বা কি? কাসেম বল ত, তুমি ঐ তরবারিখানি কোথায় পাইলে? ও তরবারি আমার, আমি বহু যত্নে, বহু ব্যয়ে মণিমুক্তা সংযোগে সুসজ্জিত করিয়াছি।”

 কাসেম বলিলেন, “বেশ করিয়াছ।—তাহাতে দুঃখ কি? তোমার মণিমুক্তাসজ্জিত তরবারির দ্বারা তোমারই চারি পুত্র বিনাশ করিয়াছি।