পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২৩
মহরম পর্ব্ব—পঞ্চবিংশ প্রবাহ

বলিতেছেন, “আক্‌বর! শীঘ্র আইস! আমি তোমার জন্য সুশীতল পবিত্র বারি লইয়া দণ্ডায়মান আছি।” আলী আক্‌বর জলপান করিতে যাইতেছিলেন, পিপাসায় তাহার কণ্ঠ শুষ্ক হইতেছিল; কিন্তু তত দূর পর্যন্ত যাইতে হইল না, জল পিপাসার শান্তি করিতেও হইল না, জন্মের মত জীবন-পিপাসা ফুরাইয়া গেল। আলী আক্‌বর অশ্ব হইতে পড়িয়া গেলেন। তাঁহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইল—শূন্যপৃষ্ঠ অশ্ব শিবিরাভিমুখে দৌড়িল। অশ্বপৃষ্ঠ শূন্য দেখিয়া আলী আক্‌বরের ভ্রাতৃদ্বয়-আলী আস্‌গর ও আবদুল্লাহ ভ্রাতৃশোকে শোকাকুল হইলেন।তিলার্দ্ধকালও বিলম্ব না করিয়া, জিজ্ঞাসা কি অনুমতির অপেক্ষা না রাখিয়া, তাঁহার দুই ভ্রাতা দুইটি অশ্বারোহণে শত্রুসম্মুখীন হইলেন। ক্ষণকাল মহাপরাক্রমে বহু শত্রু বিনাশ করিয়া তাহারা রণস্থলে বিধর্ম্মীহস্তে শহীদ হইলেন। যুগল অশ্ব শূন্যপৃষ্ঠে শিবিরাভিমুখে ছুটিল। অশ্বপৃষ্ঠে পুত্রদ্বয়কে না দেখিয়া হোসেন আহত সিংহের ন্যায় গর্জ্জিয়া উঠিলেন, বলিলেন, “এখনও কি আমি বসিয়া থাকিব? এ সময়েও কি শক্রনিপাতে অস্ত্রধারণ করিব না? পুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র—সকলেই শেষ হইল, আমি কেবল বসিয়া দেখিতেছি। আমার মত কঠিন প্রাণ জগতে কি আর কাহারও আছে?”

 হোসেনের কনিষ্ঠ সন্তান জয়নাল আবেদীন ভ্রাতৃশোকে অধীর হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে শিবির হইতে দৌড়িয়া বাহির হইলেন। হোসেন পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িয়া গিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিলেন; অনেক প্রবোধ দিয়া বুঝাইতে লাগিলেন। তাঁহার মুখে শত শত চুম্বন দিয়া তাহাকে ক্রোড়ে লইয়া শাহেরবানুর নিকট আসিয়া তিনি বলিলেন, “জয়নাল যদি শত্রু-হস্তে প্রাণত্যাগ করে, তবে মাতামহের বংশ জগৎ হইতে একেবারে নির্ম্মুল হইবে, সৈয়দ নাম আর ইহজগতে থাকিবে না। কেয়ামতের দিন পিতা এবং মাতামহের নিকট কি উত্তর করিব? তোমরা জয়নালকে সাবধানে রক্ষা কর; সর্বদাই চক্ষে চক্ষে রাখ। কোনক্রমেই ইহাকে শিবিরের বাহির হইতে দিও না।”

 হোসেন কাহারও জন্য আর দুঃখ করিলেন না। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে