পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২২৪

আকাশ পানে তাকাইয়া দুই হস্ত তুলিয়া বলিতে লাগিলেন, “দয়াময়। তুমি অগতির গতি, তুমি সর্ব্বশক্তিমান, তুমি বিপদের কাণ্ডারী, তুমি অনুগ্রাহক, তুমিই সর্ব্বরক্ষক। প্রভো! তোমার মহিমায় অনন্ত জগতের সৃষ্টি হইয়াছে! দানব, মানব, পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, তরু, তৃণ, কীটাণু এবং পরমাণু পর্য্যন্ত স্থাবর-জঙ্গম সমস্ত চরাচর তোমার গুণগান করিতেছে। তুমি মহান, তুমি সর্ব্বত্রব্যাপী, তুমিই স্রষ্টা, তুমিই সর্ব্বকর্ত্তা, তুমিই সর্ব্ববপালক, তুমিই সর্ব্বসংহারক। দয়াময়। জগতে যে দিকেই নেত্রপাত করি, সেই দিকেই তোমার করুণ এবং দয়ার আদর্শ দেখিতে পাই। কি কারণে-কি অপরাধে আবার এই দুর্দ্দশা হইল বুঝিতে পারি না। বিধর্মী এজিদ আমাকে সর্ব্বস্বান্ত করিয়া একেবারে নিঃশেষ করিল, একেবারে বংশ নাশ করিল। দয়াময়! তুমি কি ইহার বিচার করিবে না?”

 হোসেন শূন্যপথে যাহা দেখিলেন, তাহাতে অমনি চক্ষু বন্ধ করিয়া ফেলিলেন—আর কোন কথাই কহিলেন না; ঈশ্বরের উদ্দেশে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া কৃতজ্ঞতার সহিত উপাসনা করিলেন। উপাসনা শেষ করিয়া তিনি সমরসজ্জায় প্রবৃত্ত হইলেন।

 মণিময় হীরকখচিত স্বর্ণমণ্ডিত বহুমূল্য সুসজ্জায় সে সজ্জা নহে। হোসেন যে সাজ আজ অঙ্গে ধারণ করিলেন, তাহা পবিত্র ও অমূল্য। যাহা ঈশ্বর-প্রসাদাৎ হস্তগত না হইলে জগতের সমুদয় ধন দিয়াও হস্তগত হইবার উপায় নাই, জীবনান্ত পর্য্যন্ত চেষ্টা বা যত্ন করিলেও যে সকল অমূল্য পবিত্র পরিচ্ছদ-লাভে কাহারও ক্ষমতা নাই, হোসেন আজ সেই বসন-ভূষণ পরিধান করিলেন। প্রভু মোহাম্মদের শিরস্ত্রাণ, হজরত আলীর কবচ, হজরত দাউদ পয়গম্বরের কোমরবন্ধ, মহাত্মা সাহাব পয়গম্বরের মোজা,—এই সকল পবিত্র পরিচ্ছদ অঙ্গে ধারণ করিয়া তিনি যুদ্ধের আর আর উপকরণে সজ্জিত হইলেন। রণবেশে সুসজ্জিত হইয়া এমাম হোসেন শিবিরের বাহিরে দাঁড়াইলে স্ত্রীকন্যা, পরিজন সকলেই নির্ব্বাকে কাঁদিয়া তাহার পদলুণ্ঠিত হইতে লাগিলেন। উচ্চরবে কাঁদিবার কাহারও শক্তি নাই। কত কাঁদিতেছেন, কত দুঃখ করিতেছেন, এক্ষণে প্রায় সকলেরই কণ্ঠস্বর বন্ধ