পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২৫
মহরম পর্ব্ব—পঞ্চবিংশ প্রবাহ

হইয়া যাইতেছে। এমাম হোসেন সকলকেই সবিনয় মিষ্টবাক্যে একটু আশ্বস্ত করিয়া এই কথাগুলি বলিতে লাগিলেন, এবং পরিজনের এমামের সম্মুখে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলেন:—“মদিনা পরিত্যাগ করিয়া আমার কুফায় আগমন-সঙ্কল্প তোমাদের অজানা কিছুই নাই। তোমরা আমার শরীরের এক এক অংশ। তোমাদের দুঃখ দেখিয়া আমার প্রাণ এতক্ষণ যে কেন আছে, তাহা আমি জানি না!”

 সকলে সেই একই প্রকার অব্যক্ত হুহু স্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। এমাম পুনর্বার বলিতে লাগিলেন, “ইহাতে নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, ঈশ্বরের কোন আজ্ঞা আমার দ্বারা সাধিত হইবে, মাতামহের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইবে। আমি ঈশ্বরের দাস, ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্য্য করিতে আমি বাধ্য। সেই কার্য্য সাধনে আমি সন্তোষের সহিত সম্মত আছি। জন্মিলেই মানুষকে মরিতে হইবে, তবে সেই দয়াময় কি অবস্থায় কখন কাহাকে কালের করাল গ্রাসে প্রেরণ করেন, তাহা তিনিই জানেন! ইহাও সত্য যে, এজিদের আদেশ-ক্রমে তাহার সৈন্যগণ আমাদের পিপসাশান্তির আশাপথ একেবারে বন্ধ করিয়াছে। জল-বিহনে জীবনশক্তি কয়দিন জীবনে থাকে? জলই মানুষের একমাত্র জীবন। এই অবস্থাতে শিবিরে বসিয়া কাদিলে আর কি হইবে?—পুত্রগণ, মিত্রগণ এবং অন্যান্য হৃদয়ের বন্ধুগণ যাঁহারা আজ প্রভাত হইতে এই সময়ের মধ্যে বিধর্ম্মীহস্তে শহীদ হইয়াছেন, তাহাদের জন্য নীরবে বসিয়া কাঁদিলে আর কি হইবে? আজ না হয় কাল এই পিপাসাতেই সকলকে মরিতে হইবে।”

 আবার সকলে নীরবে হুহু করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। এমাম আবার বলিতে লাগিলেন, “যদি নিশ্চয়ই মরিতে হইবে, তবে বীরপুরুষের ন্যায় মরিব। আমি হজরত আলীর পুত্র, মহাবীর হাসানের ভ্রাতা; আমি কি স্ত্রীলোকের সঙ্গী হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মরিব? তাহা কখনই হইবে না। পুত্র-মিত্রগণের অকাল মৃত্যুজনিত শোকের যাতনা শত্রুবিনাশে নিবারণ করিয়া প্রাণত্যাগ করিব। আজ কারবালা প্রান্তরে মহানদী, মহানদী কেন—ঐ শোকে মহাসমুদ্রস্রোত মহারক্তস্রোত বহাইয়া প্রাণত্যাগ