পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২৩০

যাহাকে মারিতে পারিলেন, সেই অস্ত্রের দ্বারাই তাহাকে মারিয়া নরক পরিপূর্ণ করিতে লাগিলেন। শিবির অবশিষ্ট সৈন্যগণ প্রাণভয়ে যে দিকে সুবিধা উর্দ্ধশ্বাসে সেই দিকে দৌড়াইয়া প্রাণরক্ষা করিল। যাহারা তাহার সম্মুখে দৌড়াইয়া আসিল, তাহারা কেহই প্রাণরক্ষা করিতে পারিল না। সকলেই হোসেনের অস্ত্রে দ্বিখণ্ডিত হইয়া পাপময় দেহ পাপরক্তে ভাসাইয়া নরকগামী হইল। অবশিষ্ট সৈন্যগণ কারবালা পার্শ্বস্থ বিজন বনমধ্যে পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিল। ওমর, সীমান, আবদুল্লাহ জেয়াদ প্রভৃতি সকলেই হোসেনের ভয়ে বনমধ্যে লুকাইলেন।

 শত্রুপক্ষের শিবির সৈন্য একেবারে নিঃশেষিত করিয়া হোসেন ফোরাতকুলের দিকে অশ চালাইলেন। ফোরাত-রক্ষীরা হঠাৎ পলাইল না, কিন্তু অতি অল্পক্ষণের জন্যও হোসেনের অসির আঘাত সহ করিয়া তিষ্ঠিবার আর তাহাদের সাধ্য হইল না। কেহ জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল, কেহ জঙ্গলে লুকাইল, কেহ কেহ অন্যদিকে পলাইল, কিন্তু বহুতর সৈন্যই হোসেনের অস্ত্রাঘাতে দ্বিখণ্ডিত হইয়া রক্তস্রোতের সহিত ফোরাত-স্রোতে ভাসিয়া চলিল। কোন স্থানে শত্রুসৈন্যের নাম মাত্রও নাই, রক্তস্রোত মধ্যে শরীরের কোন কোন ভাগ লক্ষিত হইতেছে মাত্র। যে এজিদের সৈন্যকোলাহলে প্রচণ্ড কারবালা প্রান্তর, সুপ্রশস্ত ফোরাতকুল ঘন ঘন বিকম্পিত হইত, এক্ষণে হোসেনের অস্ত্রাঘাতে সেই কারবালা একেবারে জনশূন্য নীরব প্রান্তর! হোসেন ব্যতীত প্রাণীশূন্য ফোরাত-তীরে প্রকৃতি দেবীর বক্ষঃক্ষেত্রস্থ স্বাভাবিক শোভা একেবারে পরিবর্তিত হইয়া লোহিত বর্ণ ধারণ করিয়াছে। নিম্নভূমিতে রক্তস্রোত কল কল শব্দে প্রবাহিত হইতেছে। রক্তমাখা খণ্ডিতদেহ ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। হোসেন জল-পিপাসায় এমনই কাতর হইয়াছেন যে, তাহার আর কথা কহিবার শক্তি নাই। তিনি এতক্ষপ কেবল শত্রু-বিনাশের উৎসাহে উৎসাহিত ছিলেন। বিধর্মীর রক্তস্রোত বহাইয়া তাঁহার পিপাসার অনেক শান্তি হইয়াছিল, এখন শত্রু শেষ হইল, পিপাসাও অসহ্য হইয়া উঠিল। শীঘ্র শীঘ্র ফোরাত কুলে যাই তিনি অশ্ব হইতে অবতরণ পূর্ব্বক একেবারে জলে নামিলেন।