পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২৪২

আশা করিয়া সে হস্ত বিস্তার করিতেই যেন সখিনার মৃত শরীরে হঠাৎ জীবাত্মার সঞ্চার হইল। যেন স্বর্গীয় দূত জিব্রাইল মর্তে আসিয়া সখিনাকে কানে কানে বলিয়া গেলেন, “সখিনা! তুমি না সাধ্বী সতী? পরপুরুষ তোমার অঙ্গ স্পর্শ করিতে উদ্যত, এখনও স্বামী-চিন্তা? এখনও স্বামী-শোক? অবলার অবয়ব পরপুরুষের চক্ষে পড়িলে মহাপাপ! নিজে ইচ্ছা করিয়া তাহা দেখাইলে আরও পাপ! তুমি বীর-দুহিতা বীর-জায়া! ছিঃ, ছিঃ সখিনা! তোমারও এত ভ্রম! ছিঃ ছিঃ! সাবধান হও।”

 সখিনা ত্রস্তভাবে উঠিয়া বসিলেন; সম্মুখে চাহিতেই দেখিলেনঃ অপরিচিত যোদ্ধাসকল চারিদিকে ছুটাছুটি করিতেছে, যে যাহা পাইতেছে, তাহাই লইতেছে। হঠাৎ দুল্‌দুলের প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। হজরত এমাম হোসেনের প্রিয় অশ্ব দুল্‌দুল মৃত্তিকায় শায়িত, তাহার সমুদয় অঙ্গ তীক্ষতর তীরে বিদ্ধ, তীরসকল অশ্বশরীর বিদ্ধ করিয়া কতক মৃত্তিকাসংলগ্ন, কতক শরীরোপরি পড়িয়া রহিয়াছে। প্রতি শরের মুখ হইতে শোণিতধারা ছুটিয়া,—শ্বেতঅশ্ন ঘোর লোহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে। সখিনা একদৃষ্টে অশ্বের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। পূর্ব্ব-কথা তাঁহার স্মরণ হইল। তাহার চক্ষু উর্দ্ধে উঠিল, মুখভাব ভিন্নভাব ধারণ করিল। সজোরে কাসেমের কটিদেশ হইতে খঞ্জর লইয়া তিনি মহারাষে বলিতে লাগিলেন,—

 “ওরে কাফেরগণ! বুঝিয়াছি, কোন্ সাহসে শিবিরে আসিয়াছিস্? —কোন্ সাহসে অত্যাচার করিতে আসিয়াছিস? ওরে! আমরা অসহায়া হইয়াছি, সেই সাহসে!—ওরে! আমরা নিরাশ্রয়, সেই সাহসে! ওরে নরাধম! পুরুষ বীর আমাদের আর কেহই নাই, সেই সাহসে! ভুলিলাম! ভুলিলাম! এখন প্রাণসখা কাসেমকে ভুলিলাম! ভুলিলাম কাসেম! তোমায় এখন ভুলিলাম! নারী-জীবনের উদ্দেশ্য দেখাইতে তোমাকে এখন ভুলিলাম কাসেম! ঐ পিতার অশ্ব, তার সমুদয় অঙ্গ তীরবিদ্ধ, রক্তে রঞ্জিত,—সে মৃত্তিকায় শায়িত। আর কথা কি? আর আশা কি? এখন সখিনার আর আশা কি? কাসেম, চাহিয়া দেখ! প্রাণাধিক কাসেম! দেখ চাহিয়া, এই দেখ সখিনার হাতে তোমার খঞ্জর!!”