পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২৪৪

ইহাদের অন্তরের বিন্দুপরিমাণ স্থানও যেন অধিকার করিতে পারে নাই। সকলের হাতেই এক-একখানি শাণিত অস্ত্র। তরবারি, খঞ্জর, কাটারী, ছোরা, যে যাহা পাইয়াছে, তাহাই লইয়াছে। ধন্য রে আরবীয় নারী! তোমরাই ধন্য! পতি-পুত্র-বিয়োগ বেদনা ভুলিয়া তোমরা আজ সমরসাজে শত্রুসম্মুখীন। ধন্য তোমরা! ভ্রাতাগণ! আমাদের বীরত্বে ধিক্! অস্ত্রে ধিক্! নারীহস্তে অস্ত্র দেখিয়া কি আর এ সকল অস্ত্র ধরিতে ইচ্ছা করে? ইহারা আমাদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করুন বা না করুন, আমরা কিছুই বলিব না। ছিঃ! ছিঃ! অবলা কুলস্ত্রীর সহিত যুদ্ধ করিতে অস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা করি নাই। ভ্রাতাগণ! তোমরা আর কোন কথা বলিও না, সকলেই স্ব স্ব অস্ত্র কোষে আবদ্ধ কর। যাহা বলিবার আমিই বলিতেছি।”

 মারওয়ান অবনত মস্তকে বলিতে লাগিল, “সাধ্বী-সতী দেবিগণ! আমরা মহারাজ এজিদের আজ্ঞাবহ এবং চিরানুগত দাস। মহারাজ-আদেশে আমরাই কারবালা-ক্ষেত্রে হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসিয়াছিলাম। যুদ্ধ শেষ হইয়াছে। আমরা জয়লাভ করিয়াছি। আমরাই আপনাদের সুখতরী আজ মহারাজ এজিদের আদেশাস্ত্রে খণ্ড খণ্ড করিয়া বিষাদ-সিন্ধুতে ভুবাইয়াছি। আজিকার অস্ত্রের সহিত আপনাদের স্বাধীনতা-সূর্য একেবারে চির অস্তমিত হইয়াছে। এখন আপনারা মহারাজ এজিদসৈন্য-হস্তে চিরবন্দী। বন্দীর প্রতি অত্যাচার অবিচার কাপুরুষের কার্য্য। বরং আপনাদের জীবনরক্ষার প্রতি সর্বদা আমাদের দৃষ্টি থাকিবে। ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ হেতু যদি কোন দ্রব্যের অভাব হইয়া থাকে, বলুন, আমি সে অভাব মোচন করিতে প্রস্তুত আছি।”

 সকলেই নীরব!—কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ নীরব!—স্পন্দনহীন জড়বৎ নীরব! অনিমেষে নীরব! কেবল অল্পবয়স্ক বালিকারা শুষ্ককণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “জল! জল! আমরা তোমাদের নিকট জল চাহি; দয়া করিয়া এক পাত্র জল দাও—”

 মারওয়ান অতি অল্প সময় মধ্যে ফোরাত-জল দ্বারা অনেকের তৃষ্ণা নিবারণ করিল। কিন্তু যাঁহাদের অন্তরে পতি-পুত্র-ভ্রাতা-বিয়োগজনিত শোকাগ্নি