পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২৫০

 বা যাক্‌, প্রভাতে হইতে না হইতেই আমরা এ পবিত্র মস্তক লইয়া কারবালায় যাইব। শেষে ভাগ্যে যা থাকে হইবে!”

 পুত্রেরা বলিল, “আমাদের জীবন পণ, তথাপি কিছুতেই সৈনিকহস্তে এ মস্তক প্রত্যর্পণ করিব না। প্রাতে সৈনিককে বিদায় করিয়া সকলে একত্রে কারবালায় যাইব।”

 পুনরায় আজর বলিতে লাগিলেন,—“ধার্ম্মিকের হৃদয় এক, ঈশ্বরভক্তের মন এক, আত্মা এক! ধর্ম্ম কি কখনও দুই হইতে পারে? সম্বন্ধ নাই, আত্মীয়তা নাই, কথায় বলে-রক্তে রক্তে লেশমাত্র যোগাযোগ নাই, তবে তাঁহার দুঃখে তোমাদের প্রাণে আঘাত লাগিল কেন? বল দেখি, তাঁহার জন্য জীবন উৎসর্গ করিলে কেন? ধার্ম্মিক-জীবন কাহার না আদরের? ঈশ্বর-প্রেমিক কাহার না যত্নের? তোমাদের কথা শুনিয়া, সাহস দেখিয়া প্রাণ শীতল হইল; “পরোপকারব্রতে জীবনপণ কথাটি শুনিয়াও কর্ণ জুড়াইল। তোমাদের সাহসেই গৃহে থাকিলাম। প্রাণ দিব, কিন্তু শির দামেস্কে লইয়া যাইতে দিব না!”

 পরস্পর সকলেই হোসেনের প্রসঙ্গ লইয়া রজনী অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে যে লোমহর্ষণ ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা জগৎ দেখিয়াছে। নিশাদেবী জগৎকে আবার নূতন ঘটনা দেখাইতে, জগৎ-লোচন রবিদেবকে পূর্ব গগননপ্রান্তে বসাইয়া নিজে অন্তর্ধান হইবার উদ্যোগ করিতেছেন। জগৎ গতকল্য দেখিয়াছে, আজ আবার দেখুক—নিঃস্বার্থ প্রেমের আদর্শ দেখুক—পবিত্র-জীবনের যথার্থ প্রণয়ী দেখুক—সাধু জীবনের ভক্তি দেখুক—ধর্ম্মে দ্বেষ, ধর্ম্মে হিংসা মানুষের শরীরে আছে কিনা তাহার দৃষ্টান্ত দেখুক! ভ্রাতা, ভগিনী, পুত্র, জায়া, পরিজন বিয়োগ হইলে লোকে কঁদিয়া থাকে, জীবনকে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া জীবন থাকিতেই জীবলীলা ইতি করিতে ইচ্ছা করে। পারের জন্যও যে কঁদিতে হয়, প্রাণ দিতে হয় তাহারও জ্বলন্ত প্রমাণ আজ দেখুক, শিক্ষা করুক। সহানুভূতি কাহাকে বলে—মানুষের পরিচয় কি—মহাশক্তিসম্পন্ন হৃদয়ে ক্ষমতা কি—নশ্বর জীবনে অবিনশ্বর কি—আজ ভাল করিয়া শিক্ষা করুক।