পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯
মহরম পর্ব্ব—তৃতীয় প্রবাহ

 লেখনী ও কাগজ সকলই প্রস্তুত ছিল। আবদুল জব্বার প্রথমে পরমেশ্বরের নাম, পরে প্রভু মোহাম্মদের নাম লিখিয়া পতিপরায়ণা নিরপরাধিনী সতীসাধ্বী সহধর্ম্মিণী জয়নাবকে তালাক দিলেন। সভাস্থ অনেক মহোদয় সাক্ষিশ্রেণীতে স্ব-স্ব নাম স্বাক্ষর করিলেন। প্রতিনিধির হস্ত দিয়া সেই তালাকনামাখানি সালেহার নিকট প্রেরিত হইল। প্রতিনিধি পুনরায় সাক্ষীসহ অন্তঃপুরে গমন করিলেন। সভাস্থ সকলেই প্রফুল্লচিত্তে সুস্থির হইয়া বসিলেন; নূতন রাগে, নূতন তালে আনন্দবাদ্য বাজিতে লাগিল। বিবাহসভা সম্পূর্ণরূপেই আনন্দময়ী। আবদুল জব্বারের ভবনে জয়নাবের হৃদয়তন্ত্রী ছিড়িয়া গেল। জলপূর্ণ আঁখি দুইটি বোধ হয় জলভারে ডুবিল। আবদুল জব্বারের প্রত্যুত্তর অবধি তালাকনামা লিখিয়া প্রতিনিধির হস্তে অর্পণ করা পর্য্যন্ত জয়নাবের মুখশ্রীর ও তাঁহার অজ্ঞাত বিপদ সময়ে চিত্তচাঞ্চল্যের প্রকৃত ছবি প্রকৃতরূপে বিচিত্র করিয়া পাঠকগণকে দেখাইতে পারিলাম না। কারণ, তাহা কল্পনাশক্তির অতীত—মসী-লেখনীর শক্তিবহির্ভূত।

 প্রতিনিধি ফিরিয়া আসিলেন, পূর্ব্ব রীত্যনুসারে সভাস্থ সকলকেই পুনরভিবাদন করিয়া বলিলেন,—

 “এ সভায় রাজমন্ত্রী, রাজসভাসদ, রাজপারিষদ, রাজাত্মীয়, রাজহিতৈষী, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং বহুদর্শী ব্যক্তিগণ সকলেই উপস্থিত আছেন। সালেহা বিবি যাহা বলিলেন, ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ জানিয়া আমি তাহা অবিকল বলিতেছি, আপনারা মনযোগপূর্ব্বক শ্রবণ করুন।—

 “যে ব্যক্তি ধনলোভে, কি রাজ্যলোভে, কি মানসম্রম-বৃদ্ধির আশায় নিরপরাধিনী সহধর্ম্মিণীকে পরিত্যাগ করিতে পারে, বহুকালের প্রণয় ও ভালবাসা যে ব্যক্তি এক মুহূর্ত্তে ভুলিতে পারে, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ দাম্পত্য-প্রণয়ের বন্ধন অকাতরে ছিন্ন করিতে পারে, তাহাকে বিশ্বাস কি? তাহার কথায় আস্থা কি? তাহার মায়ায় আশা কি? এমন বিশ্বাসঘাতক স্ত্রী-বিনাশক অর্থলোভী নরপিশাচের পাণিগ্রহণ করিতে সালেহা বিবি সম্মত নহেন।”

 সভাস্থ সকলেই রাজকুমারীর বুদ্ধি ও বিবেচনার প্রশংসা করিতে